রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের পর, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কায় কাঁপছে পুরোবিশ^। কারণ, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ মানেই পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিগত কয়েক মাস থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ ভূখণ্ডের গভীরে এমন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আসছিলেন। অবশেষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষের দুই মাস আগে বাইডেন এমন অস্ত্র ব্যবহারের সবুজ সংকেত দিলেন। এর পূর্বে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছিলেন যে, এমন পদক্ষেপ মানে ন্যাটো মিত্র জোট সরাসরি ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে পুতিন বলেছিলেন, যদি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে দেয়, এটির অর্থ হবে তারা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পুতিন হুমকি দিয়ে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ চলমান যুদ্ধের প্রকৃতি এবং পরিধি বদলে দেবে। নতুন এ হুমকির বিরুদ্ধে রাশিয়া যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেও তিনি জানান। পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ কোনো দেশের মিসাইল দিয়ে ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে রাশিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। জো বাইডেনের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় মস্কো বলেছিল, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউক্রেন যদি সত্যিই মার্কিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
মার্কিন প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রয়া জানিয়ে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদায়বেলায় বাইডেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। এতে করে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এমনকি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও বলেছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ বাধাতে চান। আমার বাবা শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জীবন বাঁচানোর সুযোগ পাওয়ার আগেই তারা তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু করতে চায়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় গোয়েন্দার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রিচার্ড গ্রেনেল লেখেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে বাইডেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন, তা কেউ ধারণা করেননি। বিষয়টি এমন, তিনি নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। ফলে, সব বদলে গেল। আগের সকল হিসাব-নিকাশ এখন অকার্যকর। সিনেটর মাইক লি বলেন, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করে দিলেন জো বাইডেন। কিয়েভভিত্তিক ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সেরহি কুজান বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার রাজনীতিবিদরা একে গুরুতর উত্তেজনা বৃদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার আইনপ্রণেতা আন্দ্রেই ক্লিসাস তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হবে বলে সতর্কতা দিয়েছেন। ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে তিনি লিখেছেন, পশ্চিমারা উত্তেজনা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে সকালের মধ্যে ইউক্রেন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যেই যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালাবে, তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা হামলা চালানো হবে। এক্ষেত্রে কোনো দেরি করা হবে না। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় ধাপ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। যুদ্ধের এক হাজারতম দিনে তিনি এ সংক্রান্ত একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন বলে পুতিনের মুখপাত্র এবং ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ জানান। নতুন এই ডিক্রিতে বলা হয়, যেসব দেশের পরমাণু অস্ত্র নেই, তাদের যদি তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষ এ ধরনের বিধ্বংসী অস্ত্র প্রদান করে, সেক্ষেত্রে সেসব দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। পেসকভ বলেন, পরমাণু অস্ত্র নেইÑ এমন কোনো আগ্রাসী দেশের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ কোনো দেশ যদি জোটবদ্ধ হয়, তাহলে তা আর একক নয়; বরং যৌথ হামলায় পরিণত হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নীতি অক্ষুণ্ন রেখে যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, আমরা সেটিই নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া সবসময় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার বিপক্ষে। আমরা শুধু আমাদের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। জো বাইডেনের এ সিদ্ধান্ত ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ন্যাটো অংশীদারদের ওপর রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক নাশকতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ, পুতিন আগেই সতর্ক করেছিলেন, ইউক্রেন যদি মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসিদের ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তা মস্কোর বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে। এর ফল হবে বিপর্যয়কর। যুদ্ধ এখন সেদিকেই মোড় নিল। জি-৭ নেতাদের একটি যৌথ বিবৃতিতে ‘যতদিন সময় লাগে ইউক্রেনের প্রতি অটুট সমর্থন’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের এক হাজার দিন পূর্তিতে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ব্রাজিলে এ সপ্তাহে একই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন ১৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলমান। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইরানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগদান এই অঞ্চলের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল সে¥াট্রিচ গণমাধ্যমে আয়োজিত এক টকশোতে দখলদার রাষ্ট্রটির সীমানা ইউফ্রেটিস থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার পক্ষে জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরেন। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরোবিশে^ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে। সে¥াট্রিচ বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ঘিরে রেখেছে, সেই সঙ্গে মিসর এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অঞ্চল এবং ইরাকে পৌঁছানো অঞ্চলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত করার উচ্চাকাক্সক্ষা। এই তালিকায় সৌদি আরবও রয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, মিসর এবং এমনকি সৌদি আরবের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ইরান অত্যাধুনিক সকল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। ইরানের প্যারামিলিটারি রেভুল্যুশনারি গার্ড জানায়, এ সকল সমরাস্ত্রের মধ্যে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন রয়েছে যা সরাসরি ইসরাইলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। তেহরান মনে করে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপারেশন ট্রু প্রমিজ-থ্রি পরিচালনা করা হবে, যা ওয়ান ও টু এর চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হবে। নেতানিয়াহু প্রশাসন যা অনুমানও করতে পারবে না। গাজা ও লেবানন যুদ্ধের মধ্যে গত এপ্রিল মাস থেকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরাইলে ১৮১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়। এর জবাবে গত ২৬ অক্টোবর ইসরাইল শতাধিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে হামলা চালায় ইরানে। এই হামলায় রাজধানী তেহরানসহ দেশটির কয়েকটি প্রদেশের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এরপর থেকেই ইসরাইলে পাল্টাহামলা চালানো হবে বলে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এমন প্রদর্শনী নেতানিয়াহু প্রশাসনের জন্য অনেকটা চাপের। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ও শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইরানের নিকট। এ বিষয়ে ইরান জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, গাজায় এক বছর ধরে যে গণহত্যা চলছে, তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকেই দিতে হবে। গাজা সংকট মোকাবিলায় তার দেশ প্রয়োজনে ইসরাইলে ঢুকবে। তিনি বলেন, তুরস্ক এর আগে লিবিয়ায়ও ঢুকেছে। ইসরাইলের ক্ষেত্রেও তারা ভেতরে ঢুকতে পারবে মন্তব্য করে এরদোয়ান বলেন, এ জন্য আমাদের অনেক কঠিন হতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে এ ধরনের উপহাস করতে না পারে। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন এবং লেবাননে যারা মারা যাচ্ছে তারা শুধু নারী, শিশু এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকই নয়, মানবতা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাও। ন্যাটো জোটের মিত্রদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে এরদোয়ান নেতানিয়াহুকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, মানবতার অভিন্ন জোট যেভাবে হিটলারকে থামিয়েছে, একইভাবে নেতানিয়াহু ও তার হত্যার নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হবে। অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পশ্চিমতীরে অবৈধ ইহুদি বসতির সম্প্রসারণ ইসরাইল অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকি মোকাবিলায় ইসলামিক দেশগুলোর একটি জোট গঠন করা উচিত বলে এরদোয়ান মনে করেন। তিনি বলেন, ঐক্যই একমাত্র পদক্ষেপ, যা ইসরাইলি দাম্ভিকতা, ইসরাইলি দস্যুতা ও ইসলামিক দেশগুলোয় ইসরাইলি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে পারে। ইসরাইলের এই ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণবাদ লেবানন ও সিরিয়ার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে বলে তিনি অভিহিত করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তুরস্ক সম্প্রতি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানান। সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলাই এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য। এরদোয়ানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, এরদোয়ানের এই বক্তব্য বিপজ্জনক, মিথ্যা ও উসকানিমূলক। এরদোয়ান ইরানের সঙ্গে মিলে এই অঞ্চলের আপেক্ষাকৃত কম কট্টর দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে কাজ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজার বড় অংশই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) প্রদত্ত তথ্যানুসারে, যুদ্ধে গাজার ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ১৫ বছর তথা ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবেই ইসরাইল এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে থাকে, যা ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত। ইসরাইলের এই কুখ্যাত যুদ্ধনীতি লেবাননেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশটির রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা এবং লেবাননে ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। ইসরাইলের প্রতি ইউরোপীয় জোটের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বলেন, ইইউ এখন পর্যন্ত ইসরাইল সরকারকে যেকোনো অর্থবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলেছে। গাজা এবং লেবাননে ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে বোরেল ইসরাইল থেকে আমদানি নিষিদ্ধ থেকে শুরু করে দখলদার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ স্থগিত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই জোটের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করারও আহ্বান জানান।
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে উত্তেজনাও চরমে। এতে আমেরিকা জড়িত থাকায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। চীনও তাদের সমর্থন দিচ্ছে। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনাও ক্রমশ সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজিত করছে। আবার দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিতে চীন ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ চলমান। এই বিরোধে আবার ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ^ আজ বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ইসরাইলের পক্ষে কথা বললেও তুরস্ক, রাশিয়া এবং চীন, গাজা ও তেহরানের প্রতিই সমর্থন বাড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, চীন সবসময়ই ইরানের বিশ^স্ত অংশীদার এবং বরাবরের মতোই ইরানকে সমর্থন করবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির চাপ আরোপের বিরোধিতা করবে চীন। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, তার দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইউরোপের দেশগুলো প্রস্তুত করছে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন যদি ব্যর্থ হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপকে যুদ্ধে জড়িয়ে দেবে। মস্কোর বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোর যুদ্ধ করা তাদের জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। ক্রেমলিন জানিয়েছিল, রাশিয়া ‘পরমাণু নীতি’ পাল্টে ফেলবে। এমনকি যে দেশগুলোর নিকট আণবিক অস্ত্র নেই, তাদেরকেও আক্রমণ করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র নিকট চূড়ান্ত সতর্কতা হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েই আমরা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করব। এখনই আমরা এটা করতে চাই না। কিন্তু আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত থাকতে চাই। এখন পুতিনের বক্তব্যই সঠিক হতে চলেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরমাণু অস্ত্রের সামরিক মহড়া দিয়ে ইউক্রেন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সরাসরি হুমকি দিল রাশিয়া। এর ফলে, ইউক্রেন থেকেই তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়