বন্ধু থেকে যেভাবে শত্রু হলো ২ টি দেশ
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো বিংশ শতাব্দীতে গঠিত হয়েছে, যেখানে ইরান ও মিশর প্রাচীন সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসাবে সবসময়েই উচ্চাসনে থেকেছে। বিগত ১৫০ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দুটি দেশ যেমন একে অপরের খুব কাছাকাছি এসেছে নানা বিষয়ে, তেমনই আবার সংঘাত ও শত্রুতার পথও বেছে নিয়েছে দেশ দুটি।
এখন মিশর ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক চেষ্টার পরেও এখনও একে অপরের দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে নি। কিন্তু গাজার যুদ্ধ এবং লেবাননের ওপরে ইসরায়েলি হামলা তেহরান ও কায়রো সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে কাছাকাছি আসার, সম্পর্ক ভালো করার।
ইরানের কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক গতিবিধি নজর করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, ইরানের তরফ থেকে সমঝোতার একটা প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে মিশর সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্লেষণ করতে হবে যে কেন ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিগত কয়েক বছর ধরেই মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর প্রচেষ্টা করছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে আলাপ করার উদ্দেশ্যেই ইরানের বিদেশ মন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির মিশর সহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে সফর করেছেন। লেবানন, ইরাক ও সৌদি আরব সফরের পরে আরাঘচি কায়রো গিয়েছিলেন।
এই কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোতে মিশরের একটা ভূমিকা আছে। তাদের সঙ্গে শুধু যে ইসরায়েলের সীমান্ত রয়েছে তা নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কও আছে মিশরের। এছাড়াও হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনাতেও মিশর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইরান আর মিশরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে ভৌগলিক দূরত্ব এবং নানা গুরুতর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বজায় থাকার অনেকগুলি কারণ আছে। তবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরের কিছু ঘটনা এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার করছে।
অতীতে এই অঞ্চলটি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, পরে ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মতো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির উপস্থিতির কারণে ইরান ও মিশর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা মজবুত হয় নি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ হয়ে যায় মিশর কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তা দখল করে নেয় যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাজ্য ১৯২২ সালে মিশরের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয় কিন্তু দেশটির পররাষ্ট্রনীতি, সেনাবাহিনী, সুয়েজ খালের মতো বিষয়গুলি স্বাধীন দেশের কাছে হস্তান্তর করতে রাজী হয় নি তারা। ইরানের ব্যাপারে কিন্তু যুক্তরাজ্যের ভিন্ন নীতি ছিল।
তারা ইরানে রেজা শাহ নামে এক সামরিক কমান্ডারকে সমর্থন দেয়, যিনি ১৯২১ সালে এক সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে অনেকটাই ক্ষমতা দখল করে নেন। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই আহমদ শাহ কাজারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেজা শাহ নিজেই পাহলভি রাজা নাম নিয়ে ক্ষমতায় বসেন।
এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ইরান ও মিশরে এমন দুই শাসক এলেন যাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণে নিজের দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও হিতের বদলে যুক্তরাজ্যের নির্দেশ বেশি গুরুত্ব পেত। অন্যদিকে মিশরের সঙ্গে ইরানের রেজা শাহের সম্পর্ক পুরোপুরি ঠিক হতে প্রায় দুই দশক সময় লেগেছিল।
ইরানের শাহ যখন নিজের বড় ছেলে ও যুবরাজ মুহম্মদ রেজার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন, তখন তার পছন্দ হয়ে গেল মিশরের বাদশাহ ফারুকের বোন ফৌজিয়াকে। এই বিবাহসূত্রই রেজা শাহ ও মিশরের বাদশাহ ফারুক – দুজনের জন্যই রাজনৈতিক লাভ বয়ে এনেছিল। পাহলভি পরিবারের সদ্যপ্রাপ্ত বাদশাহিকে একটা আইনি মান্যতা দেওয়ার জন্য এই বিবাহ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
আবার মিশরের বাদশাহ ফারুকের যে দেশ পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণেই চলত, যাকে আরব দেশগুলো ‘কাঠপুতুল সরকার’ বলেই মনে করত, এই বিবাহবন্ধন বাদশাহকেও শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিল। তিনি জেনে বুঝেই এই বিয়েতে মত দিয়েছিলেন নিজের লাভের কথা ভেবে। ইরানের যুবরাজ মুহম্মদ রেজা পাহলভি ও মিশরের শাহজাদী ফৌজিয়ার বিয়ের পরেই আধুনিক ইতিহাসে প্রথমবার এক দেশ অন্য দেশে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল।
এভাবেই তেহরান ও কায়রোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়। সেই সময় দুই দেশের পারিবারিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।
বিবিসি
তাসমিম