লরা গ্রিফিথ।
যে ভাগ্যের জোরে এক রাতে হয়েছিলেন কয়েক কোটি টাকার মালিক, সেই ভাগ্যের হাতেই পর্যদুস্ত হয়েছেন লরা গ্রিফিথ। ব্রিটেনের ইস্ট ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা লরা লটারিতে জিতেছিলেন ২০ কোটি টাকা। এত টাকা জিতেও প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন লরা। একে একে হারিয়ে ফেলেন সমস্ত সম্পদ ও স্বামীকে।
লটারি জেতার আগে ইস্ট ইয়র্কশায়ারে সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন লরা ও তার স্বামী রজার। বছর তিরিশের এই দম্পতি তাদের দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে থাকতেন একটি ছোট বাড়িতে। প্রাচুর্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না গ্রিফিথ দম্পতির সংসারে।
লরা ছিলেন একজন শিক্ষিকা। রজার ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ম্যানেজার। এই সুখী পরিবারের চিত্রটা হঠাৎ করে বদলাতে শুরু করে ২০০৫ সালের পর থেকে। একসঙ্গে ২০ কোটি টাকা হাতে পাওয়ার পরই তাদের জীবনের গতি সম্পূর্ণ অন্যদিকে বাঁক নেয়।
একসঙ্গে এত টাকা হাতে আসার পরই মাথা ঘুরে গিয়েছিল তাদের। বিলাসবহুল জীবনের দিকে দ্রুত আকৃষ্ট হন লরা ও রজার। আচমকা লটারি জিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি ছেড়ে দেন। তার পরই নিজেদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন আস্তানার সন্ধান করতে থাকেন। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি কেনেন দু’জনে। সেই শখ পূর্ণ হওয়ার পর দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর দিকে মন দেন।
দুবাই, ফ্লরিডা, ফ্রান্স কোনও জায়গা বাদ দেননি এই দম্পতি। সব ক’টি বিদেশভ্রমণ ছিল বিলাসিতায় মোড়া। সেখানেও কয়েক কোটি টাকা খরচ করেন তারা। চাকরি ছেড়ে নিজেরা ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন লরা ও রজার। দেড় কোটি দিয়ে একটি স্যালোঁ কেনেন লরা। এ ছাড়া, একাধিক দামি ও বিলাসবহুল গাড়িও ছিল এই দম্পতির গ্যারাজে। দামি ব্র্যান্ডের ব্যাগের প্রতি লরার ঝোঁক ছিল। সেই শখ মেটাতেও মোটা টাকা ব্যয় করেছিলেন তিনি।
আর্থিক অবস্থা ফিরতেই দুই মেয়েকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেন লরা ও রজার। রজার মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে ছেলেবেলার শখ পূরণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল রক গায়ক হওয়ার। এ ছাড়া নিয়মিত আয়ের বন্দোবস্ত করতে লটারিতে পাওয়া টাকা স্টক মার্কেটেও বিনিয়োগ করে দেন। কিন্তু এই সুদিন স্থায়ী হয়নি। পর পর কয়েকটি দুর্ঘটনার ফলে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন লরা।
২০১০ সালে তাদের স্বপ্নের বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। কোনও মতে সেই বাড়ি সারিয়ে এক বছর পর আবার ওই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন তারা। পরিস্থিতি সামলে ওঠার আগেই আরও একটি ধাক্কা নেমে আসে লরার জীবনে। রজারের একটি গোপন ইমেল লরার চোখে পড়ায় তাদের দাম্পত্যে ফাটল ধরে। ২০১৩ সালেই দু’জনের বিবাহবিচ্ছেন ঘটে। স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে নিজের মা-বাবার কাছে ফিরে আসেন রজার। সেই সময় রজারের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৫০ টাকা।
সংবাদমাধ্যমের কাছে রজার স্বীকার করে জানান, নিজেদের দোষেই তারা সব হারিয়েছিলেন। সম্পদের অপব্যবহার করে ফেলেছিলেন, এমন স্বীকারোক্তিই উঠে এসেছিল রজারের গলায়।
লরাও সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলে বলেন, কেউ যখন পরিশ্রম না করে বিপুল টাকার মালিক হয়ে যান, তখন তার দুঃসময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ান না। লটারিতে অর্থলাভের আগে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল তা বলতে গিয়ে লরা জানান, রজার ও তার মধ্যে খুবই কম মতপার্থক্য ঘটত। রজার অনলাইনে সপ্তাহে মাত্র ২ পাউন্ডের বাজি ধরতেন। এই পরিমাণ অর্থ হাতে পাওয়ার পর তাদের ধারণা ছিল না কী ভাবে এর সদ্ব্যবহার করতে হয়।
২০১৩ সালের পর থেকে লরার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যেতে থাকে। দুই সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। তখন থেকেই লরার লড়াইয়ের শুরু। বিচ্ছেদের পর তার আর্থিক সমস্যা আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। বাড়ি, স্যালোঁ সব বিক্রি করে দিতে হয়।
লরা জানান, একটি সুখী পরিবারের ভাঙন ও বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে লরার সন্তানদের উপর। নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনায় মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে লরার বড় মেয়ে। বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা মনে করলে এখনও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
সব হারিয়ে এখন দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের মায়ের সঙ্গে একটি সাধারণ বাড়িতে থাকেন লরা। বড় মেয়ে রুবির এখন বয়স ২০। আর কিটির বয়স ১৭। লটারি জেতার পরেই ছোট মেয়ের জন্ম হয়। লরা বর্তমানে একজন পেশাদার রূপটান ও ট্যাটু শিল্পী। লটারি জয়ের টাকা নষ্ট নিয়ে তার আর কোনো অনুশোচনা নেই। তবে বুদ্ধির প্রয়োগ সঠিক হলে জীবনের গল্পটা অন্য রকম হতে পারত বলে মনে করেন তিনি।
এম হাসান