ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১

জার্মান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ- এর অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ ইউজিসির

ভুয়া পিএইচডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২২:২৯, ৮ নভেম্বর ২০২৪

ভুয়া পিএইচডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের  কোষাধ্যক্ষ

.

নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে জার্মান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। অথচ বিজ্ঞপ্তির কোনো শর্তই পূরণ না করে অধ্যাপক বনে যান তিনি। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রি এবং যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বে¡ পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) পদও বাগিয়ে নেন মোয়াজ্জেম।

সম্প্রতি বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। জালিয়াতি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে তদন্তেও। ইউজিসির গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটি চলতি বছরের ২৭ জুন সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে মোয়াজ্জেম হোসেনের নিয়োগ বাতিল, ট্রেজারার পদ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক, প্রশাসনিক আর্থিক অবস্থা করুণ শোচনীয় উল্লেখ করে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় কমিটি গঠনের সুপারিশও করা হয়।

ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে জার্মান ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ইউজিসিতে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। একই বছরের ২৬ অক্টোবর ইউজিসি অভিযোগ তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়।

এতে আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসির তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক . হাসিনা খান। বাকি তিন সদস্য হলেন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ, উপ-পরিচালক রাবেয়া খন্দকার। সদস্য সচিব ছিলেন একই বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. মুহিববুল্লাহ। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং অভিযুক্ত মোয়াজ্জেম হোসেনের সাক্ষাৎকার নেন। গত ২৭ জুন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জার্মান ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার পদে নিযুক্ত হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর পদে নিয়োগ পান। প্রফেসর পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যেসব যোগ্যতা, শর্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ ছিল, তার জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনো শর্তই পূরণ করে না। পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়ে কমিটির সদস্যদের কাছে খোদ মোয়াজ্জেম হোসেন স্বীকার করেন যে, তার পিএইচডি ডিগ্রিটি ব্যবহার করা উচিত হয়নি। তিনি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া।

মোয়াজ্জেম হোসেনের যেসব প্রকাশনা রয়েছে, তার কোনোটিই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নয়। কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধকে প্রকাশনা হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি। তা ছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ বা শ্রেণির কথা উল্লেখ থাকলেও মোয়াজ্জেম হোসেনের কোনো স্তরে প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি নেই। 

নিয়োগ বোর্ডের সব নথিপত্র গায়েব মোয়াজ্জেম হোসেনের নিয়োগ বোর্ডের নথিপত্র চেয়েও পায়নি ইউজিসি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নিয়োগ বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক . মো. শামসুদ্দীন। জালিয়াতি যোগ্যতা না থাকলেও কেন মোয়াজ্জেমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে তদন্ত কমিটিকে তিনি জানান, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী নিয়োগের জন্য কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা নথি তদন্ত কমিটিকে দেখাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া নিয়োগ বোর্ডে সদস্যদের উপস্থিতির স্বাক্ষর সংবলিত নথি, নিয়োগের বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে কি না, তার নথি চেয়েও পায়নি তদন্ত কমিটি।

জাল নথি-কাগজপত্র তৈরি করেছেন ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন যা প্রয়োজন, সে অনুযায়ী কাগজপত্র নথি তৈরি করছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রফেসর পদে নিয়োগের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি প্রয়োজন থাকায় তিনি নিজের নামের আগে ডক্টরেট উল্লেখ করে আবেদন করেছেন। আবার যখন ট্রেজারার পদে নিয়োগে ডক্টরেট ডিগ্রির প্রয়োজন নেই, তখন নামের আগে ডক্টরেট বাদ দিয়েছেন।

তা ছাড়া ট্রেজারার পদের জন্য জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে তিনি সরকারি জিবিজি কলেজে ১৯৮৫-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। অথচ প্রফেসর পদের জন্য দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে তিনি জিবিজি ইউনিভার্সিটি কলেজ, টাঙ্গাইলে ১৯৮৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটির কাছে যথাযথ জবাব দিতে ব্যর্থও হয়েছেন মোয়াজ্জেম।

ইউজিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে সব কিছুরই উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে অপসারণ করতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

বিষয়ে মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের একাধিক নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর . এসএম ইকবাল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, তদন্ত প্রতিবেদন আমি দেখেছি। এই প্রতিবেদন এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। সেখান থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

×