ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

মার্কিন ভোট ॥ তাকিয়ে বিশ্ব

নাজিম মাহমুদ

প্রকাশিত: ২২:২১, ৫ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২২:৪৩, ৫ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন ভোট ॥ তাকিয়ে বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে ভোট দিচ্ছেন এক ভোটার, কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

হোয়াইট হাউসের পরবর্তী বাসিন্দা কে-তা নির্ধারণে ভোট দিলেন মার্কিনীরা। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টার কাঁটা স্পর্শ করতেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে সবার আগে ভোট দেন ভারমন্টের বাসিন্দারা। দেশটির পূর্ব উপকূলের অঙ্গরাজ্যটিতে স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট শুরু হয়। অঙ্গরাজ্যভেদে সময়ের ব্যবধান এবং একেক রাজ্যে একেক সময় ভোট শুরুর সময় থাকায় নির্বাচনের ফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে।

এই নির্বাচন এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন ইউক্রেন, ফিলিস্তিনের গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যুদ্ধ চলছে। এসব দীর্ঘ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। তাই বিশ্ব শান্তি ও অন্যান্য ইস্যুতে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও সিএনএন অনলাইনের। 
বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা যখন অস্থির, তখন মার্কিন জনগণ ভোটকেন্দ্রে হাজির হন। এই নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বন্ড, শেয়ারবাজারসহ অর্থ বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা নির্বাচনী ফলাফলের অপেক্ষায়, যা মার্কিন এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এই নির্বাচনে ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে যিনিই বিজয়ী হোন না কেন, এর ফলে মার্কিন কর ও বাণিজ্যনীতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিন্নধর্মী প্রভাব পড়তে পারে। ভোটের ফল মার্কিন ডলার ও বন্ড মার্কেটসহ বিশ্বের আর্থিক বাজারেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
ভোটের দিনও বিভিন্ন জরিপে বলা হয়, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ক্ষমতাসিন ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা কমলা দেবী হ্যারিসের মধ্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে ফ্লোরিডার এক কেন্দ্রে ভোট দেন। ভোটের পর তিনি বলেন, আমরাই ফিরছি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন ভোর অপেক্ষা করছে। আর ডাকযোগে ভোট দেন কমলা।  
এর আগে কমলা হ্যারিস পেনসিলভানিয়ায় তার শেষ প্রচার সমাবেশে একতার শক্তি ও নারী অধিকারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন লড়ি, আমরা জিতি’। সমাবেশে উপস্থিত জনতাকেও সমস্বরে তার এই কথার সঙ্গে গলা মেলানোর ডাক দেন কমলা। জনতার সামনে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘আমরা কি আমেরিকার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করি? আপনারা কি এর জন্য লড়তে প্রস্তুত? কারণ, আমরা যখন লড়ি, তখন আমরা জয়ী হই। ভাষণে তিনি আরও বলেন, আমি  জয়ের আসনে পৌঁছাবই।’
তিনি বলেন, আমাদের এই জীবনকালে গুরুত্বপূর্ণ ভোটের মুহূর্তটি আমাদের অনুকূলেই আছে। এ নির্বাচন হতে পারে ইতিহাসে অন্যতম তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। 
অপরদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, কমলা হ্যারিস নয়, তিনি অশুভ ডেমোক্র্যাট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছেন। মিশিগানে শেষ প্রচার সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা ওয়াশিংটনে এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে পরাজিত করবই। কারণ, আমি কমলার বিরুদ্ধে লড়ছি না। অশুভ ডেমোক্র্যাট সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ছি। এরা দুষ্ট লোক। এই যাত্রা অবিশ্বাস্য হবে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, এ যাত্রা হবে দুঃখেরও। কারণ, এটাই হবে শেষবার। মঙ্গলবারের নির্বাচনে না জিতলে আগামীতে আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার পরিকল্পনা নেই বলে জানান ট্রাম্প।

মিশিগানে শেষ দিনের প্রচারে তিনি তাই বলেন, ‘এটিই আমার শেষ প্রচার।’ তবে জরিপে জনমর্থনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে ট্রাম্প এও বলেছেন যে তিনি আশাবাদী। ট্রাম্প বলেন, ‘সুসংবাদ আছে। আমরা যা কিছু করছি তা আমাদের জয় পাওয়ার অবস্থানেই নিয়ে যাচ্ছে। এর পর ভোট শুরুর পরই ভোটারদের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা দেন, কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক এক্স পোস্টে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা লেখেন, ‘আমেরিকা, এটা আপনাদের আওয়াজ তোলার মুহূর্ত।’
নিজের ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘এটা বেরিয়ে আসার ও ভোট দেওয়ার সময়। আমরা একসঙ্গে আমেরিকাকে আবার মহান করতে পারব!’
উল্লেখ্য, আমেরিকার মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান সামনে রেখে নির্বাচনী লড়াই করছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখবে দেশটির দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো। এসব অঙ্গরাজ্যে যিনি এগিয়ে যাবেন তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট।  স্থানীয় সময় ভোর ৬টায় কানেকটিকাট, নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক, নিউ হ্যাম্পশায়ার এবং ভার্জিনিয়াসহ আটটি রাজ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

ভোটাররা কেন্দ্রগুলোতে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রে ভোটারাদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। এ ছাড়া ইন্ডিয়ানা এবং কেন্টাকিতে ভোর ৬টায় ভোট শুরু হলেও এসব রাজ্যের কিছু অঞ্চলে সকাল ৭টার দিকে ভোটকেন্দ্রগুলো খোলা হয়। কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু রাজ্যে মোতায়েন করা হয়েছে স্নাইপার ইউনিট। 
জর্জিয়ায় এক অনাকাঙ্খিক ঘটনা ঘটে। সেখানে একজন নির্বাচনকর্মী তারই সহকর্মীদের ওপর বোমা হামলার হুমকি দিয়েছেন। এ অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।  
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হবে। দেশটিতে ভোট দেওয়ার যোগ্য নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি, তারমধ্যে ১৬ কোটির মত ভোটার এবার ভোট দিতে নিবন্ধন করেছেন। আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি ভোটার। ভোটের আগে সবশেষ জনমত জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে সামান্য এগিয়ে আছেন হ্যারিস। তবে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ হিসেবে বিবেচিত রাজ্যগুলোতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যবধান সামান্য। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের সবগুলো এবং উচ্চকক্ষ সেনেটের ১০০ আসনের ৩৪টিতেও একইসঙ্গে ভোট হচ্ছে।

জলহস্তী শাবকের ‘ভবিষ্যৎ বাণী’ ॥ ডোনাল্ড ট্রাম্পই আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরছেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক শোরগোল ফেলে দিয়েছে থাইল্যান্ডের এক শিশু জলহস্তী। থাইল্যান্ডের মহাতারকা খ্যাত শিশু জলহস্তী মু ডেং ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরছেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। থাইল্যান্ডের চনবুড়ি এলাকার খাও খেও ওপেন চিড়িয়াখানায় এই ভবিষ্যদ্বাণী করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ঝড় তুলেছে মু ডেং। ট্রাম্পের বিষয়ে করা ভবিষ্যদ্বাণীর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে মুহূর্তের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে যায়।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চার মাস বয়সী শিশু জলহস্তী মু ডেংকে দু’টি ফলের ঝুড়ি দেওয়া হয়। এর একটিতে রিপাবলিকান দলীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অপরটিতে ডেমোক্র্যাট দলীয় কমালা হ্যারিসের নাম লেখা রয়েছে। এর মধ্য থেকে ট্রাম্পের নাম লেখা ঝুড়ি থেকে ফল খেতে শুরু করে পিগমি জলহস্তী মু ডেং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মু ডেংয়ের এই ভিডিও ব্যাপক ঝড় তুলেছে। 
ঘরের মেয়ের জন্য প্রার্থনা ॥ ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলার আদি নিবাস যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে। সেখানে হ্যারিসের পিতৃপুরুষের গ্রাম থুলাসেন্দ্রপুরমে চলছে পূজার্চনা-প্রার্থনা। মন্দিরে পুজা দেন গ্রামবাসীরা, প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে। প্রার্থনা একটাই- ঘরের মেয়ে যেন জেতে। 
তামিলনাড়ুর ছায়া সুনিবিড় থুলাসেন্দ্রাপুরাম গ্রামে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে জন্ম নিয়েছিলেন হ্যারিসের নানা পিভি গোপালান। চেন্নাই থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের এই অখ্যাত গ্রামই এখন শিরোনামে। রাতারাতি প্রচারের আলোয় আসার কারণ স্বয়ং কমলা হ্যারিস। তার নানা পিভিগোপালান পরে থুলাসেন্দ্রাপুরাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন চেন্নাই। সেখান থেকে ভারতীয় কূটনৈতিক হিসাবে যান জাম্বিয়ায়। কমলার মা শ্যামলা গোপালনের নিবিড় যোগসূত্র নেই এই গ্রামের সঙ্গে। আর সেভাবে দেশে ফেরেনি গোপালন পরিবার। কিন্তু থুলাসেন্দ্রপুরমের বাসিন্দারা মনে করে কমলা হ্যারিস তাদের ঘরের মেয়েই।
মঙ্গলবার সকালে মন্দিরে হ্যারিসের জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। তিনি জিতলে বিশেষ উৎসব উদযাপনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি মন্দিরেও কমলার জন্য প্রার্থনা হয়। 
২০২০ সালে কমলা জো বাইডেনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর গ্রামের বাসিন্দারা উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলেন। একইভাবে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে হ্যারিস নির্বাচনে লড়াই করাতেও আনন্দিত গ্রামবাসীরা। 
হ্যারিসের পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে গ্রামের রাস্তা-ঘাট। মন্দিরে চলছে পূজার্চনা। হ্যারিস একবার জানিয়েছিলেন তিনি দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাই তার পছন্দের রান্নাও খাওয়াচ্ছেন গ্রামবাসীরা। 
এই নির্বাচনে যদি কমলা জয় পান তাহলে দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করবেন এই ঝানু আইনজীবী। ভেঙ্গে যাবে ২৩৫ বছরের মার্কিন ইতিহাস। অপরদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে প্রথমবারের মতো ৩৪ মামলার আসামী হোয়াইট হাউসে পা রাখবেন। শুধু তাই নয় সবচেয়ে বেশি বয়সী মার্কিন প্রেসিডেন্টও হবেন তিনি।

×