.কমলা ও ট্রাম্প
নতুন এক ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে যুক্তরাষ্ট্র। আজকের নির্বাচনে যদি ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা দেবী হ্যারিস জয় পান, তাহলে দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করবেন ৬০ বছর বয়সী এই ঝানু আইনজীবী। অপরদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে প্রথমবারের মতো ৩৪ মামলার আসামি হোয়াইট হাউসে পা রাখবেন। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে বেশি বয়সী মার্কিন প্রেসিডেন্টও হবেন তিনি। তবে ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করা ট্রাম্পের জীবন এখন সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে। কারণ নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলে তার জায়গা হবে অন্ধকার কারাগার।
ট্রাম্পের নামে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে, ক্যাপিটল হিলে হামলায় উস্কানি, পর্নো তারকাকে ঘুষ, আয়কর জালিয়াতি, বিচারব্যবস্থার ওপর অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের দেওয়া উপহার সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া ইত্যাদি।
গত ৩১ মে ফেডারেল আদালতের ১২ সদস্যের জুরি বোর্ড জানায়, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা সব ক’টি অভিযোগই প্রমাণিত। কয়েক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টের সাজার শুনানি হয়নি।
ট্রাম্পের আইনজীবীরা বারবার আদালতের কাছে সাজা ঘোষণার দিনক্ষণ পেছানোর আবেদন করেন। ফলে কয়েক দফা সেই তারিখ বদলানো হয়। আদালনের নির্দেশ অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত ট্রাম্পের সাজা ঘোষণা হতে পারে ২৬ নভেম্বর। নির্বাচনের ২০ দিন পর। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তার বিরুদ্ধে ওঠা ফৌজদারি মামলা স্থগিত হয়ে যেতে পারে। তবে হারলে আবার আইনি লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। খবর বিবিসি, আলজাজিরা ও সিএনএন অনলাইনের।
এদিকে নির্বাচনে চূড়ান্ত ফল নির্ধারণী দোদুল্যমান সাত রাজ্যে শেষ সময়ের জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে চমক দেখা গেছে। সোমবার ব্রাজিল-ভিত্তিক এই জরিপ সংস্থা অ্যাটলাস ইনটেলের জনমত জরিপের ফলে বলা হয়েছে, দোদুল্যমান সাত রাজ্যের সবকটিতে কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তাদের ব্যবধান একেবারে সামান্য।
ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মাঝে ব্যাপক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য জনমত জরিপেও। অ্যাটলাস ইনটেলের জরিপের ফলে দেখা যায়, দোদুল্যমান রাজ্য অ্যারিজোনায় জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং হ্যারিসের প্রতি ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। দোদুল্যমান আরেক রাজ্য নেভাদায় জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৬ শতাংশ হ্যারিসকে সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া নর্থ ক্যারোলিনায় ট্রাম্প ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ জনসমর্থন। অ্যাটলাস ইনটেলের জনমত জরিপ অনুযায়ী, জর্জিয়া রাজ্যেও এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই রাজ্যে ৫০ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান বলে জানিয়েছেন। মিশিগানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হ্যারিসের প্রতি ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। আর পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও কমলা হ্যারিস ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং উইসকনসিনে ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হ্যারিস ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন। দেশটির সাত রাজ্যে অ্যাটলাসের পরিচালিত এই জনমত জরিপে গড়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে তিনি কমলা হ্যারিসের ৪৭ দশমিক ২ শতাংশের তুলনায় ৪৯ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন। অ্যাটলাস ইনটেল বলেছে, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও সবচেয়ে নির্ভুল জনমত জরিপ প্রকাশ করেছিল তারা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি দোদুল্যমান রাজ্যে করা তাদের জনমত জরিপের ফল সঠিক হয়েছিল। আজ মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ শুরু হলেও চূড়ান্ত ফল জানতে কৌতূহল রয়েছে অনেকের মাঝে। খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ভোটগ্রহণ শেষ হবে। সাধারণত, যে সব রাজ্যের ভোট দ্রুত গণনা হয়, সেসব রাজ্যের ফল রাতেই পাওয়া যেতে পারে।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্য নিজদের নিয়ম অনুযায়ী ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারণ করে থাকে। এরপর শুরু হয় ভোট গণনা। তবে সাধারণত স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভোট গণনার সময়ের পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যে যখন ভোট গণনা শুরু হবে, তখন আলাস্কা, ওহাওয়াইয়ের মতো অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা তখনও ভোট দিতে থাকবেন। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের ভোটের চূড়ান্ত ফল কখন জানা যাবে তা নির্ভর করছে দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় তার ওপর।
যুক্তরোষ্ট্রে ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে উভয় দলের জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা থাকে। সেই রাজ্যগুলোর ফল চূড়ান্ত না হলে, নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল জানার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে। যদি এসব রাজ্যে ভোটের ব্যবধান খুব কম থাকে, তবে ফল ঘোষণা কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। তবে যদি কোনো প্রার্থী এসব রাজ্যে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকেন, তাহলে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল দ্রুত জানা সম্ভব হবে। ২০২০ সালের নির্বাচনের মতো এবারও আগাম ভোট ও ডাকযোগে ভোটগ্রহণের কারণে ফল ঘোষণায় বিলম্ব হতে পারে। ডাকযোগে ভোট দেয়া হলে গণনা কয়েকদিন ধরে চলে এবং অনেক রাজ্যে আইন অনুযায়ী ভোটগ্রহণ শেষের পর পৌঁছানো ডাকভোটও গণনা করা হয়। সোমবার প্রকাশিত সিএনএন-এসএসআরএসের জরিপে একটি চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন ট্রাম্প পরাজিত হলে এবারের ফলও প্রত্যাখ্যান করবেন।
বিষয়টি ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হলে কিছুটা ঠাট্টার সুরে বলেন, যদি ‘সুষ্ঠু ও বৈধ এবং ভালো নির্বাচন’ হয় তাহলে অবশ্যই মেনে নেব।
চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প নিজেই দোদুল্যমান রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় ব্যাপক ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে দাবি করেন। ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, আমরা তাদের পেনসিলভানিয়ায় বিরাট আকারে জালিয়াতি করতে দেখেছি। এজন্য তিনি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে বিচারও দাবি করেন। ট্রাম্পের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কর্মকর্তারা পেনসিলভেনিয়ার তিনটি কাউন্টিতে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে ভোটার নিবন্ধন আবেদন এবং জালিয়াতির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে কাজ করছেন। এবারের নির্বাচনে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ব্যালট পেপারে ইংরেজির পাশাপাশি যে চারটি বিদেশী ভাষা ঠাঁই পেয়েছে, সেসবের একটির নাম বাংলা। ক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা বোর্ড অব ইলেকশন্সের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য শাখার নির্বাহী পরিচালক মাইকেল জে রায়ান সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
সেই ব্রিফিংয়ে রায়ান বলেন, “অভিবাসী ভোটারদের সুবিধার জন্য ব্যালট পেপারে ইংরেজির পাশাপাশি ৪টি ভাষা অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোর্ড অব ইলেকশন্স নিউইয়র্ক শাখা। এই ভাষাগুলো হলো চীনা, স্প্যানিশ, কোরিয়ান এবং বাংলা। নিউইয়র্ক সিটির বিখ্যাত টাইমস স্কয়্যার এলাকার একটি দোকানে কাজ করেন শুভাশিষ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিউিইয়র্কে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি নিজে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, তবে এখানে আমাদের কমিউনিটিতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা বাংলাভাষার ব্যালট পেপার দেখলে স্বস্তি বোধ করবেন। ভোটকেন্দ্রে এটি তাদের জন্য সহায়ক হবে। আমি নিশ্চিত যে আমার বাবা এই ব্যাপারটি পছন্দ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক রাজ্যটি অধিবাসী অধ্যুষিত। দেশটির মোট অভিবাসীদের একটি বড় অংশ থাকেন নিউইয়র্ক সিটিসহ এই রাজ্যের বিভিন্ন শহরে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গোটা নিউইয়র্কে ২ শতাধিক ভাষায় কথা বলেন লোকজন। এসবের মধ্যে হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, তামিলসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাও রয়েছে। কিন্তু সেসবের মধ্যে ভারতীয় ভাষা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে একমাত্র বাংলাকে।
ব্রিফিংয়ে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে মাইকেল জে রায়ান বলেন, “আমি বুঝতে পারছি যে (ব্যালট পেপারের জন্য) অন্যান্য ভারতীয় ভাষাকে বাদ দিয়ে শুধু বাংলাকে বেছে নেওয়ায় ভাষাভাষী ভারতীয়রা হয়তো মনোঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কিন্তু এটা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার অধিকার আইন, ১৯৬৫-এর আওতায় দু’বছর আগে একটি মামলা করা হয়েছিল নিউইয়র্কের আদালতে। মামলাকারীদের দাবি ছিল, নিউইয়র্কে যেসব অঞ্চলে অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি, সেসব অঞ্চলে ইংরেজির পাশাপাশি অন্তত একটি অভিবাসী ভাষায় ব্যালট পেপার প্রদান করা হোক। পরে নিউইয়র্কের রাজ্য প্রশাসন ও মামলাকারী দু’পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে এই চার ভাষায় ব্যালট পেপার প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
শহিদ