ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্পে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। এটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের নির্বাচনের মতো নয়, এর ওপর নির্ভর করে বিশ্বরাজনীতি। শেষ মুহূর্তে চলছে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্পের জোর প্রচার।
এ নির্বাচনের ফলে মোড় নেবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। এখন প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন মুলুকের এ নির্বাচন কি ঢাকা-ওয়াশিংটন ডিসির সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে? কারণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন অব্যাহত পশ্চিমা সমর্থন। কিন্তু এই নির্বাচনের পর তাতে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে বহুমাত্রায় চলছে বিশ্লেষণ।
সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নানা টানাপোড়েন ছিল বাংলাদেশের। তবে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফরে এসে পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস দেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। পাশাপাশি জাতিসংঘেরও পূর্ণ সমর্থন পায় ইউনূস সরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং উন্নয়নের প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে—এ নিয়েও লু বাংলাদেশের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সুশাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সক্ষমতা বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ২০ কোটি ডলার সহায়তার আশ্বাস দেয় ওয়াশিংটন ডিসি। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলছেন, ড. ইউনূস বিশ্বনন্দিত। তার সঙ্গে ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্পর্ক ভালো হওয়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কেন: বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ আর বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে অনেকটাই দৃশ্যমান যে, ঢাকার রাজনীতিতে আগ্রহ রয়েছে ডেমোক্র্যাটদের। তবে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলেই বাণিজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগী হয় বিধায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যত তাদের আগ্রহ নেই বলে মনে করেন কূটনীতিকরা।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ একটি গণমাধ্যমকে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব কাঠামোর কারণেই ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান উভয় দলই বাংলাদেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ক্ষতি কোথায়: ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষায় তৈরি হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরু থেকে সহায়তা করছেন ডেমোক্র্যাট নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে সমীকরণ ঘুরে যেতেও পারে বলছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি জানান, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রসারে মনোযোগী হবেন। তিনি তাই হয়তো আগের বারের মতোই শুল্ক আরোপে কঠোর হবেন।
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক সংকুচিত হতে পারে। ফলে জলবায়ু সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুত সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা অর্থায়ন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদেরও সংকট হতে পারে বলেও মনে করেন এই কূটনীতিক। এদিকে সাবেক আরেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ মনে করেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ভারতের কঠোর চাপে থাকবে বাংলাদেশ। আর অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হবে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের লাভ না ক্ষতি: ৫ আগস্টের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। মব জাস্টিসের মাধ্যমেও তারা কয়েকজন নিহত হয়েছেন। গুঞ্জন আছে, নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে তার কাছে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়তা চাওয়া হতে পারে। তবে এ স্বপ্ন পূরণ হবে না বলে মনে করেন দেশের কূটনীতিকরা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যেহেতু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়বে। তাই ভারত প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে পারলেও ট্রাম্পের কাঁধে চড়ে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন, ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা না আসাতে কিছুই পরিবর্তন হবে না। তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়লে এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের মতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামানো কমবে। আর সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি একই থাকে, যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন। তাই আলাদা করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব মধুর হওয়ার মতন কিছু দেখছি না।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে ট্রাম্পের নিন্দা নতুন কৌশল: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার এক্সে (টুইটার) পোস্ট করেন ট্রাম্প। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকলেও এমনটা হতো না। এই সাবেক প্রেসিডেন্ট আরও লেখেন, ক্ষমতায় এলে নরেন্দ্র মোদির (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও বাড়বে। পরে সবাইকে হিন্দুদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দীপাবলির শুভেচ্ছাও জানান ট্রাম্প। তবে হঠাৎ বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে ট্রাম্পের এত আগ্রহের কারণ অন্যভাবেই দেখছেন কূটনীতিকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ মনে করেন, ৫ নভেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকান-ভারতীয় কমিউনিটির সমর্থন ও ভোটের জন্যই ট্রাম্প সংখ্যালঘুদের নির্যাতনে নিন্দা জানিয়ে নতুন কৌশল ব্যবহার করছেন। তবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলছেন, বর্তমানে যেহেতু সমালোচনা আছে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে। তাই তিনি বিষয়টিতে আরও জোর দিয়েছেন। কারণ, এতে তিনি ভারতীয়দের সমর্থন পেতে পারেন।
ট্রাম্প না কমলা, কাকে ক্ষমতায় চায় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো: বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন। চীনের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়লে তা বাংলাদেশের জন্যও হুমকির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক বলছেন, চীন চায় ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক। কারণ, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট দেখা দেয়। ফলে চীন শক্তিশালী বলয় তৈরি করতে পারে। এদিকে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমলেও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমেই বাড়বে। আর সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ট্রাম্প এলে বাড়বে; কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে কিছুটা সমস্যায় পড়বে ভারত। কারণ, ট্রাম্প আগেও ক্ষমতায় এসে নিজ দেশের অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ট্রাম্প জিতলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করলে বৈশ্বিকভাবে এর প্রভাব পড়বে বলে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ।
কমলা এলে কী সুবিধা বাংলাদেশের: ট্রাম্প না কমলা, বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে কে জিতলে! নির্বাচনের আগে এখন এমন প্রশ্নই ঘুরছে। তবে কূটনৈতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কমলা ক্ষমতায় এলে লাভবান হবে বাংলাদেশ। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় বহাল থাকলে বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই থাকবে; বরং কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সহায়তা বা চুক্তি আরও বাড়বে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানেও তারা সহায়তা করবে। আর অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, কমলা ক্ষমতায় এলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্ভাবনা বাড়ানোতে জোর দিতে পারেন। এদিকে সাবেক আরেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলছেন, ট্রাম্প মুসলিমবিদ্বেষী। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে মুসলিম দেশগুলো চাপে থাকবে। তবে ডেমোক্র্যাটরা মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যায়।
তাসমিম