.
আর তিনদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের আগে দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএন একটি চমকপ্রদ খবর ছেপেছে। শুক্রবার প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়, নির্বাচনে হারলে এবারও ‘ঝামেলা’ করার পরিকল্পনা এঁটেছে ট্রাম্প সমর্থকরা। কারণ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল এখনো মেনে নেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প সমর্থকদের একটি বড় অংশ এখনো বিশ্বাস করে, সেই নির্বাচনের ফল চুরি করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একইরকম চুরি যেন এবার না হতে পারে, তা নিয়ে বদ্ধপরিকর রিপাবলিকান শিবির। চুরি হলে, অর্থাৎ ট্রাম্প নির্বাচনে হারলে কীভাবে ফল পাল্টাতে হবে, সেই পরিকল্পনাও করে রেখেছে তার কট্টর সমর্থকরা। তারা এই আন্দোলনের নাম দিয়েছে চুরি থামাও আন্দোলন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিংহভাগ অঙ্গরাজ্যের ফল প্রতিবার একই থাকে। কয়েকটি রাজ্যে ফল ঘনঘন বদলায়, যেগুলোকে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেট বলা হয়। এসব অঙ্গরাজ্য নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো আছে ট্রাম্প শিবিরের। হতে পারে ক্যাপিটল হিল দাঙ্গার মতো বিক্ষোভও।
গত মাসে মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ থেকে প্রকাশিত এক বুলেটিনে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে (ট্রাম্প শিবিরের) চরমপন্থি বক্তব্য আবারও ২০২০ সালের মতো সহিংসতা ডেকে আনতে পারে। ক্যাপিটল দাঙ্গার তদন্ত করা মার্ক হ্যারিস বলেন, যারা নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে চায়, তারা ২০২০ সালের চেয়ে এবার বেশি সংগঠিত। তবে নির্বাচন ব্যবস্থার রক্ষকরাও প্রস্তুত। এখন বিষয়টা কোনোদিকে গড়াবে, তা বলা যাচ্ছে না।
কিছু ট্রাম্পপন্থি নির্বাচনে হারলে আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে চায়। যদি এক-দুই রাজ্যের ফল উল্টে দিলেই ট্রাম্পকে জেতানো সম্ভব হয়, তাহলে এরকম রাজ্যগুলোতে নির্বাচনে কারচুপির মামলা দিয়ে ফল বদলানোর চেষ্টা করবে তারা। খবর সিএনএন, আলজাজিরা ও বিবিসি অনলাইনের।
যেহেতু দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ওপরই ফল নির্ভর করতে যাচ্ছে, তাই সেই পাঁচ-সাতটি রাজ্যে আইনি প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে তারা। আবার এই নির্বাচনের আরেকটি দিক হচ্ছে, মোট ভোটের ওপর না, রাজ্যের ইলেক্টরদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ফল যাই হোক, ইলেক্টররা শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকেই ভোট দেবেন, এই ব্যবস্থাও করার চেষ্টা করছে কিছু ট্রাম্পপন্থি গোষ্ঠী।
আবার সহিংসতার মাধ্যমে নির্বাচন বিঘ্নিত করে ফল পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। সাধারণত বড় শহরগুলোতে ডেমোক্র্যাটরা বেশি ভোট পায়। একটি রাজ্যের যেসব অঞ্চলে ডেমোক্র্যাটদের বেশি পাওয়ার ভোট সম্ভাবনা আছে, সেখানে ট্রাম্প শিবির গোলযোগ করতে পারে। ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মিশেল ফ্লিন বলেন, ২০২০ নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষের পর এবার গণনা চলছে এমন ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়ে সহিংসতা চালাতে পারে তারা। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, নির্বাচনী সহিংসতার মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দিতেও প্রস্তুত কিছু চরমপন্থি গোষ্ঠী। তারা সরকারি স্থাপনা ও বিপক্ষ দলের ওপর সরাসরি হামলা করতে পারে।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার সিবিএস নিউজের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অক্টোবরের শুরুতে টেলিভিশন চ্যানেলটিতে ‘৬০ মিনিটস’ নামের অনুষ্ঠানে প্রচারিত ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিসের এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে এই মামলা করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, মামলার অভিযোগে ট্রাম্প ‘সাক্ষাৎকারটি বিভ্রান্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ফেডারেল আদালতে এই মামলা করা হয়। এতে অভিযোগ করা হয়, ওই সাক্ষাৎকারে গাজায় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে করা একটি প্রশ্নে কমলার ভিন্ন দুটি উত্তর প্রচার করেছে সিবিসি। তবে ভিন্ন ওই দুটি উত্তর কী ছিল, তা প্রতিবেদনে জানানো হয়নি। এই মামলায় ১ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। সিবিএসের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘৬০ মিনিটস অনুষ্ঠানটি নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ট্রাম্প সিবিএসের বিরুদ্ধে যে মামলাটি করেছেন, সেটির গ্রহণযোগ্যতা নেই। এর বিরুদ্ধে আমরা শক্তভাবে লড়ব।’
কমলার সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প বারবার সিবিএস নেটওয়ার্ককে আক্রমণ করে আসছিলেন। নির্বাচিত হলে তিনি নেটওয়ার্কটির অনুমোদন বাতিল করবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। ওদিকে মার্কিন পপতারকা, অভিনেত্রী ও প্রযোজক জেনিফার লোপেজ বলেছেন, ‘আমি নারীর শক্তিতে বিশ্বাস করি। এই নির্বাচনে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার ক্ষমতা নারীদের আছে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেছেন লোপেজ। বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার এই সমাবেশ হয় স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে। লোপেজ তার ক্যারিয়ারে অনেক মঞ্চেই পারফর্ম করেছেন। তবে বৃহস্পতিবার রাতের এই সমাবেশ-মঞ্চকে তার জন্য ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ’ বলে অভিহিত করেন। সমাবেশে লাতিনোদের শক্তির কথাও উল্লেখ করেন লোপেজ। তিনি বলেন, ‘আমি লাতিনোদের শক্তিতে বিশ্বাস করি। লোপেজকে তার সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী লাতিনো বিনোদন-তারকা হিসেবে গণ্য করা হয়। ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নেভাদাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। এখানকার ভোটারদের মধ্যে হিস্পানিকদের অংশভাগ গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্গরাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা। বিষয়টি সম্পর্কে বেশ ভালো করেই অবগত কমলা শিবির। এ কারণে ভোট টানতে তারা শেষ মুহূর্তের নির্বাচনী প্রচারে নেভাদার সমাবেশমঞ্চে লোপেজকে হাজির করে। সমাবেশে কমলার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ ট্রাম্পের সমালোচনা করেন লোপেজ। তিনি বলেন, ট্রাম্প আমাদের বিভক্ত করার জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছেন।
শেষ মুহূর্তের প্রচারে অভিনব কা- ঘটাচ্ছেন উভয় নেতা। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার ময়লার ট্রাকের চালক হিসেবে সমর্থকদের সামনে আসেন। একই সঙ্গে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম ভোট টানতেও ঘাম ঝরাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতির বন্যা। নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউসে পা রাখার আগেই মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধ বন্ধ চান ট্রাম্প। প্রকাশ্যে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে এলেও যুদ্ধ বন্ধের জন্য অনেক আগেই সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়ে বার্তা পাঠান ট্রাম্প। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে উঠে এসেছে এই খবর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারের শুরু থেকেই ট্রাম্প বলে এসেছেন, একমাত্র তিনি ক্ষমতায় এলেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব। গত জুলাইয়ে ফ্লোরিডার বাসভবন মার ই লাগোতে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন নেতানিয়াহু। তখনই নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন ট্রাম্প। ইসরাইল ও মার্কিন সূত্রগুলো বলছে- আগামী সপ্তাহের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী রিপাবলিকান প্রার্থী। জয়ের পর জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই যুদ্ধের অবসান চান সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। খবর সিএনএন ও আলজাজিরা অনলাইনের।
নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে ট্রাম্প নাকি বলেছেন, গাজায় বেসামরিক লোকদের ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ ইসরাইল শুরু করেছে তা বিশ্বের জন্য খুব খারাপ। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা বরাবরই ইসরাইল বলতে অন্ধ। প্রশাসনে বদল এলেও ইসরাইলের প্রতি নীতিতে তাদের সমর্থনে কোনো পরিবর্তন আসে না। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ইসরাইলের দানবীয় আগ্রাসন আর মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে প্রচারে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছেন কমলা ও ট্রাম্প উভয়ই। এক বছর ধরে ফিলিস্তিনের ওপর নির্বিচার গণহত্যায় মার্কিনিরা ইসরাইলের একনিষ্ঠ সমর্থন থেকে সরে এসেছেন।
দেশটির বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরগুলোতে প্রায়ই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইহুদিদের পাশাপাশি মুসলিম অভিবাসীদেরও বড় একটা প্রভাব রয়েছে। আর মুসলিম ও ইসরাইলবিরোধী ভোটারদের দলে টানতে কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্প প্রতিদিনই নিত্য নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের জন্য বাইডেন ও কমলা হ্যারিসকে দায়ী করে ট্রাম্প বলছেন-তিনি ক্ষমতায় না আসলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এমনকি বুধবার লেবাননের মুসলিমদের উদ্দেশ করে দেওয়া এক বার্তায় তাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন রিপাবলিকান এই প্রার্থী। আবার তিনি জয় না পেলে ইসরাইল ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ইহুদি ভোটারদেরও মন জয়ের চেষ্টা করছেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি ট্রাম্প সমর্থকদের ‘আবর্জনা’ বলে সম্বোধন করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যদিও পরবর্তীতে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের নয়, বরং সমাবেশে ট্রাম্পের ঘৃণ্য বক্তব্য সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন। তবে, বাইডেন যে কারণেই এমন মন্তব্য করে থাকুন না কেন, সেটিকে কাজে লাগিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আগাম ভোট পড়েছে ৬ কোটির বেশি ॥ ভোটের দিন ভিড় কমানোর এবং ভোটদাতাদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য আগেই একদিন ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ইলেকশন ল্যাবের তথ্য বলছে, ছয় কোটিরও বেশি ভোটদাতা এবার আগাম ভোটের সুবিধা নিয়েছেন। ইলেকশন ল্যাবের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড জানিয়েছেন, তিনি কলোরাডো, জর্জিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, ভার্জিনিয়া-সহ ছয়টি ল্যাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ছয় কোটি ২০ লাখ ভোটদাতা ২০২৪ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আর্লি ভোট দিয়েছেন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যত মানুষ ভোট দিয়েছিলেন, তার ৪০ শতাংশ আগাম ভোট দিয়েছেন।