ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

এই হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ স্পৃহাকে আরও শক্তিশালী করবে

এবার হামাসের নয়া প্রধান সিনওয়ারকে হত্যা করল ইসরাইল

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

এবার হামাসের নয়া প্রধান সিনওয়ারকে হত্যা করল ইসরাইল

ইয়াহিয়া সিনওয়ার

এবার ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের নয়া প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। বুধবার দক্ষিণ গাজায় এক অভিযান চালিয়ে ৬১ বছর বয়সী এই নেতাকে হত্যা করে তারা। কয়েক মাস আগে ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার পর সংগঠনটির দায়িত্ব কাঁধে নেন সিনওয়ার। ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে তিনি আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন করে বড় ধাক্কা খেল সংগঠনটি।
গত বছরের সাত অক্টোবর ইসরাইলের মাটিতে নজিরবিহীন হামলা চালান হামাস যোদ্ধারা। ইসরাইল ও পশ্চিমাদের মতে ইয়াহিয়া সিনওয়ার ওই  হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অপরদিকে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সাফ জানিয়েছে, সিনওয়ারকে হত্যা করা হলেও আমাদের লড়াই থামবে না। সংগঠনটি শুক্রবার সিনওয়ারের মৃত্যু নিশ্চিত করে। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ইহুদীবাদী ইসরাইল আমাদের দমাতে পারবে না। হিজবুল্লাহর একনিষ্ঠ সমর্থক ইরান বলেছে, এই হত্যাকা- আমাদের প্রতিরোধ স্পৃহাকে আরও শক্তিশালী করবে। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও পার্স টুডে অনলাইনের। 
সিনওয়ারকে হত্যা প্রসঙ্গে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, হামাস প্রধানের হত্যা মানে যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। তিনি এটিকে গাজায় বছরব্যাপী যুদ্ধের ‘শেষের সূচনা’ বলে আখ্যা দেন। সিনওয়ারের হত্যাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি আরও বলেন, গাজায় চলমান যুদ্ধ ‘আগামীকালই’ শেষ হতে পারে, যদি হামাস অস্ত্র ফিরিয়ে দেয় এবং গাজায় আটক বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে দেয়। এর আগে জিম্মিদের পরিবারের উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার প্রিয়জনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারছি, ইসরাইল সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়বে। কারণ তারা আমাদেরও প্রিয়জন’।
এরপর নেতানিয়াহু গাজাবাসীকে বলেন, সিনওয়ার আপনার জীবন ধ্বংস করেছে। তিনি বলেন, হামাস আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করবে না। এটি হামাসের পরবর্তী দিনের শুরু এবং গাজার বাসিন্দারা, অবশেষে হামাসের অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য এটি একটি সুযোগ। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী-আইডিএফ বলেছে, বুধবার রাফা শহরের একটি ভবনে অভিযান চালানো হয়। ধারণা করা হয়েছিল যে ভবনটি হামাসের সিনিয়র নেতারা ব্যবহার করেন। সেই অভিযানে তিনজন নিহত হন।

সিনওয়ার তাদের মাঝে একজন। আইডিএফ আরও জানায়, ওই স্থানে জিম্মির কোনো চিহ্ন নেই। আইডিএফ এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেন, তিনজন বন্দুকধারীকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়াতে দেখেছে সৈন্যরা। গুলি চালানো হলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ও সিনওয়ার একা ভবনে প্রবেশ করেন।
হ্যাগারি আরও বলেন, ড্রোন দিয়ে দেখা গেছে, সিনওয়ার একটি চেয়ারে বসে আছেন। ইসরাইলি সৈন্যরা ভবনে প্রবেশ করে নিহত এই হামাস প্রধানকে একটি ভেস্ট, বন্দুক ও ৪০ হাজার শেকেলসহ দেখতে পায়। আইডিএফ প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল হার্টজি হালেভি বলেন, আমরা বলেছিলাম আমরা তাকে ধরব এবং তাকে ধরেছিও। তাকে ছাড়া পৃথিবী এখন ভালো।
সিনওয়ারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করতে কয়েক ঘণ্টা দেরি হয় কারণ ইসরাইল সিনওয়ারের দাঁতের রেকর্ড ও আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে দেখছিল। ইসরাইলের কাছে সিনওয়ারের জেনেটিক ডেটা সংরক্ষিত রয়েছে। কারণ তিনি তার জীবনের কয়েক দশকই কাটিয়েছেন ইসরাইলের কারাগারে। এর আগে একবার অনলাইনে কিছু গ্রাফিক চিত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা গেছে, সিনওয়ারের মতো দেখতে একটি মৃতদেহ মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। আইডিএফ সেসময় জানায়, তাকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসরণ করা একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত না হয়ে বলতে চায়নি তারা।
সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ ২২ বছরেরও বেশি সময় অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি কারাগারে কাটান। কারাগারে থাকার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবার কিছু সময় সম্পূর্ণ নির্জন কারাবাস ছিল, যা তাকে আরও কঠোর   করে তোলে। সিনওয়াকে হত্যার ঘটনা ইসরাইলের জন্য অন্যতম বড় সাফল্য বলে মনে করছেন বিশ্ব নেতারা। পাশাপাশি গাজায় যুদ্ধ অবসানের পথ খুলবে বলেও প্রত্যাশা তাদের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার তাকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসের নেতা এবং ‘হলোকাস্টের পর ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনের নেপথ্যের হোতা হিসেবে বর্ণনা করেন।

স্টারমার বলেন, ‘আজ আমি গত বছর ৭ অক্টোবরে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাব। সিনওয়ারের মৃত্যুতে যুক্তরাজ্য শোক প্রকাশ করবে না। সব জিম্মির মুক্তি, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এসবই অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে। সুতরাং, আমরা এখন মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই শান্তির পথে হাঁটতে পারি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস উভয়ই সিনওয়ারের হত্যাকা- নিয়ে বিবৃতি দেন। 
বাইডেন বলেন, ‘আজকে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য এটি একটি শুভ দিন। ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ায় গাজার বুকে হামাসের ক্ষমতার অবসান ঘটবে বলে আশা করি। ফলে বিশ্বে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার সুযোগ তৈরি হবে। এতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পাবে। হোয়াইট হাউস জানায়, সিনওয়ারকে হত্যার মিশনে সফল হওয়ায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানান বাইডেন। এখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কীভাবে জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করেছেন তারা।

তাছাড়া, ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যুদ্ধের সমাপ্তির বিষয়েও তাদের মধ্য কথা হয়েছে। উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে নির্বাচনী প্রচারের সময় কমলা হ্যারিস বলেন, ন্যায়বিচার হয়েছে। এছাড়া কানাডা, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশ সিনওয়ার নিহতের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানান। 
এদিকে পশ্চিমারা গাজায় যুদ্ধবিরতির আশা করলেও সিনওয়ারের মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। ইসরাইল এই মাসে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে। আর এখন গত ১ অক্টোবরে হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মিত্র ইরানের চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। ইয়াহিয়া সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজা উপত্যকার নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে থাকতেন।

বলা হচ্ছিল সেখানে তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী এবং ইসরাইল থেকে আটককৃত কিছু জিম্মি ছিল যাদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে যখন তিনি দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলি টহলদারদের একটি দলের মুখোমুখি হন তখন তার সঙ্গে খুবই কম সংখ্যক দেহরক্ষী ছিল। কোনো বন্দিও সেখানে পাওয়া যায়নি।

×