ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১

কাজের চাপে তরুণীর মৃত্যু, কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্ক

প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৫:৪৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কাজের চাপে তরুণীর মৃত্যু, কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্ক

.

কর্পোরেট সংস্থার কাজের পরিবেশকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে ২৬ বছরের ভারতীয় তরুণী অ্যানা সেবাস্টিয়ান পেরাইলের মর্মান্তিক মৃত্যু।  মহারাষ্ট্রে পুণের একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করতেন অ্যানা। গত ২০ জুলাই তার মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যুর জন্য কর্মসংস্থার অতিরিক্ত কাজের চাপকেই দায়ী করেছেন অ্যানার বাবা-মা।

পুনের নামকরা হিসাব নিরীক্ষণ সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং (ইওয়াই)-এ মাত্র চার মাস আগে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন কেরালার তরুণী অ্যানা। তার মৃত্যুতে কর্পোরেট সংস্থায় কাজের সংস্কৃতি এবং কর্মীদের কল্যাণের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

অ্যানার মা অনিতা অগাস্টিন ইওয়াই ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান রাজীব মেমনিকে লেখা এক চিঠিতে দাবি করেছেন যে, কর্মক্ষেত্রে চাপের কারণে তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। আনা প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরতেন অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায়। সপ্তাহশেষের ছুটিতেও কাজ করতে হতো তাকে। একজন নতুন কর্মী হিসেবে তাকে 'অমানবিক পরিশ্রম' করতে হত বলে দাবি মায়ের।

তার অভিযোগ, কাজের চাপ এতটাই ছিল যে, ঘুম, খাওয়াদাওয়া ভুলে দিনরাত কাজেই ব্যস্ত থাকতে হত অ্যানাকে। ঠিক মতো খেতে পারত না, ঘুমোতে পারতেন না সে।

অ্যানার বাবা সিবি জোসেফও জানিয়েছেন, মেয়ে মাঝেমধ্যেই কাজের চাপের বিষয়টি তাদের কাছে জানাতেন। জুলাইয়েই এক হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অ্যানাকে। তিনি জানিয়েছিলেন, অ্যানার শরীর ঠিকই আছে। কিন্তু ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া এবং ঘুমোনো প্রয়োজন।

অ্যানার মায়ের অভিযোগ, অমানুষিক কাজের চাপে মেয়ের শরীর ভেঙে গিয়েছিল। তাই তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।

বিবিসি জানায়, অ্যানার মৃত্যুর পরই বহুজাতিক সংস্থার চেয়ারম্যানকে তার মায়ের লেখা চিঠিটি গত সপ্তাহে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরপরই কর্মপরিবেশ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। অনেকেই ইওয়াই ইন্ডিয়ায় কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত সংস্কৃতির নিন্দা করেন। টুইটার, লিংকডইনে কেউ কেউ শেয়ার করেন এই সংস্থায় তাদের কাজ করার অভিজ্ঞতাও।

বেঙ্গালুরুর এক বাসিন্দা ইওয়াই ফার্মে তার স্ত্রীর কাজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন। তিনি জানান, তার স্ত্রী সংস্থার 'বিষাক্ত সংস্কৃতির' জন্যই কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার উপর কাজ করতে হতো তার স্ত্রীকে।

লিঙ্কডইনে এক পোস্টে তিনি লেখেন, “গাধার মতো খাটানো হতো। ২৪x৭x৩৬৫ কাজ করানো হতো। আশা করব অ্যানার এই মৃত্যু অফিসের কাজের চাপে হওয়া শেষ মৃত্যু হবে।”

সংস্থাটির আরেক সাবেক কর্মী, ইন্দোরের বাসিন্দা জৈন বলেন, “আমি বুঝতে পারছি অ্যানার মানসিক অবস্থা কী ছিল।” এক্স হ্যান্ডলে স্ক্রিনশট পোস্ট করে তিনি লেখেন, “২০ ঘণ্টা ডিউটি শেষ হত ভোর ৫টায়। ২০ ঘণ্টা ডিউটি করতে হত আমাদের। একাধিকবার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি। শরীর ভেঙে পড়েছিল। মাথা ঘুরত। পেরে উঠতাম না আর। কোম্পানির জন্য আমরা কেবলমাত্র নম্বর। ভাগ্যিস আমি সময় মতো বেরিয়ে এসেছিলাম। যতদিন না কর্মীদের সুরক্ষার জন্য কোনও আইন তৈরি হবে ততদিন তাদের উপর মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ পড়বেই।”

আরও এক লিঙ্কডইন ব্যবহারকারী লিখেন, “৯ থেকে ১০ ঘণ্টার জন্য লগ ইন করতে দেওয়া হলেও ১৪ ঘণ্টা কাজ করানো হতো কর্মীদের।”

তবে অ্যানার মৃত্যু ঘিরে এই বিতর্কের মধ্যে ইওয়াই সংস্থার চেয়ারম্যান রাজীব মেমানি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ‘কাজের চাপে’ অ্যানার মৃত্যু হয়নি বলেই দাবি তার।

রাজীবের যুক্তি, ভারত জুড়ে এক লাখেরও বেশি কর্মী তাদের সংস্থায় কাজ করছে। তার কথায়, ‘‘সন্দেহ নেই যে, আমাদের সংস্থায় কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু একথা বিশ্বাস করতে পারছি না যে, কাজের চাপেই ওই তরুণী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।’’ তবে তিনি বলেন, তাদের সংস্থার কর্মীর মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। তার পরিবারের প্রতি তিনি সমবেদনা জানাচ্ছেন।

ইওয়াইয়ের পক্ষ থেকে এও বলা হয়েছে যে, কর্মীদের ভালো থাকার বিষয়টিকে এই সংস্থা অগ্রাধিকার দেয়। কাজের জায়গায় কর্মীদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়া সংস্খার লক্ষ্য।

তবে অতিরিক্ত কাজের চাপে কর্মী মৃত্যুর গুরুতর অভিযোগের মুখে নড়েচড়ে বসেছে ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রণালয়। অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। ইওয়াই এখন শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্তের মুখে। সেখানে অসুরক্ষিত এবং শোষণমূলক কাজের পরিবেশ রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বার্তা সংস্খা রয়টার্স লিখেছে, মহারাষ্ট্রের শ্রম দপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার শৈলেন্দ্র পল জানিয়েছেন, কর্মচারিদের কতক্ষণ কাজ করতে হবে সে ব্যাপারে শ্রম দপ্তরের কোনও আইনি অনুমোদন ছিল না ইওয়াই ইন্ডিয়ার।

তাছাড়া, ২০০৭ সালে তৈরি হওয়া ইওয়াই ইন্ডিয়া সংস্থার ওয়ার্ক আওয়ার রেগুলেশনের কোনও পারমিট ছিল না বলে জানিয়েছেন মহারাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

মহারাষ্ট্রের শ্রম দপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার পলের নেতৃত্বাধীন একটি তদন্ত দল ইওয়াই ইন্ডিয়ার কার্যালয়ে কাজের পরিবেশ খতিয়ে দেখছে। সেই দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজ্যের শপস অ্যান্ড এসট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় কোনও রেজিস্ট্রেশন করা নেই সংস্থাটির। এ আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক কার্যালয়ে কর্মচারীদের প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলা রয়েছে।

সংবাদসংস্থাকে শৈলেন্দ্র পল বলেন, “২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য রাজ্য শ্রম দপ্তরে আবেদন জানিয়েছে। আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, সংস্থাটি তৈরি হয়েছে ২০০৭ সালে। তখন তারা আবেদন জানায়নি। এতদিন কেন আবেদন জানানো হল না সে ব্যাখ্যা তাদেরকে দিতে বলা হয়েছে ৭ দিনের মধ্যে।

“এতদিন আইন না মানার কারণে যদি কোনও কর্মচারীর ক্ষতি হয়ে থাকে অথবা মৃত্যু হয় সেক্ষেত্রে ৬ মাস কারাবাস হতে পারে কর্তৃপক্ষের। দিতে হতে পারে পাঁচ লাখ রূপি জরিমানাও।”
 

 

তাসমিম

×