ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

কী কারণে এবারের হজে এত বেশি মৃত্যু?

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৩ জুন ২০২৪

কী কারণে এবারের হজে এত বেশি মৃত্যু?

এবারের হজে বাংলাদেশেরও অন্তত ৩১ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

গত কয়েক বছর চেষ্টা করেও হজের ভিসা জোগাড় করতে ব্যর্থ হন মিশরীয় নাগরিক ইয়াসির। এ কারণে এবার অবৈধভাবে গিয়ে হজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি এবং তার স্ত্রী। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের জন্যই এখন পস্তাচ্ছেন ইয়াসির।

গত রবিবার থেকে ইয়াসিরের স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর তীব্র গরমের মধ্যে হজ করতে গিয়ে মারা যাওয়া এক হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে তার স্ত্রীও রয়েছেন। ইয়াসির বলেন, আমি মক্কার প্রতিটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি। ও (স্ত্রী) সেখানে নেই।

৬০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এ প্রকৌশলী এখনো সৌদির একটি হোটেলে অবস্থান করছেন। তার আশা, এ ঠিকানাতেই হয়তো তার স্ত্রী ফিরে আসবেন।

গত শুক্রবার (২১ জুন) ইয়াসির টেলিফোনে বার্তা সংস্থা এএফপি’কে বলেন, আমি বিশ্বাস করতে চাই না, সে মারা গেছে। যে যদি মারা যায়, তাহলে আমার জীবনও শেষ।

এ বছর হজ করতে গিয়ে গত ২০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ১ হাজার ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৬৫৮ জন মারা গেছেন মিশরীয় নাগরিক। এবারের হজে বাংলাদেশেরও অন্তত ৩১ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

সৌদির একজন কূটনীতিক এএফপিকে বলেছেন, হজ করতে গিয়ে মৃত ৬৫৮ জন মিশরীয় নাগরিকের মধ্যে ৬৩০ জনই অনিবন্ধিত ছিলেন। এর মানে, হজযাত্রাকে সহনীয় করে তুলতে কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তারা পাননি; যেমন- শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু।

ইসলামের পবিত্রতম স্থান মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ এলাকায় তাপমাত্রা ৫১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠায় হজযাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য এ ধরনের তাঁবুর ব্যবস্থা করেছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ।

সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেবল রোববারই ২ হাজার ৭০০টির বেশি ‘তাপজনিত ক্লান্তি’র ঘটনা রিপোর্ট করেছিল। কিন্তু তারপর থেকে এই সংখ্যাটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। হজে মৃতদের বিষয়েও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি সৌদি সরকার।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হজ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য জীবদ্দশায় একবার হলেও হজ করা ফরজ।

দেশগুলোর জন্য কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে হজের অনুমতি বরাদ্দ করে সৌদি আরব এবং লটারির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তা বিতরণ করা হয়।

তাছাড়া, বৈধভাবে হজে যাওয়ার খরচ অনেক বেশি হওয়ায় অনেকেই অবৈধপথে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে হজ করতে গেলে কয়েক হাজার ডলার কম খরচ হয়। বিশেষ করে, সৌদি আরব ২০১৯ সালে সাধারণ পর্যটন ভিসা দেওয়া শুরু করার পর থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।

কিন্তু গত মে মাসে সৌদিতে পৌঁছানোর পরপরই অনিবন্ধিত হজযাত্রী হওয়ার সমস্যাগুলো হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেতে থাকেন ইয়াসির ও তার স্ত্রী।

হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই কিছু দোকান এবং রেস্তোরাঁ তাদের সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, তারা নুসুক নামে পরিচিত অফিসিয়াল হজ অ্যাপে অনুমতি দেখাতে পারেননি।

এরপর, হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলে নির্ধারিত বাসগুলোতে চড়তেও সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাদের। বাসে উঠতে গুণতে হয় মোটা অংকের টাকা। কিন্তু এর জন্য কোনো রশিদ পাননি তারা।

পরে তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়লে মিনার একটি হাসপাতালে জরুরি সেবা নিতে গিয়েছিলেন ইয়াসির। কিন্তু অনুমতি না থাকায় সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

ধীরে ধীরে তাদের অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত, ‘শয়তানকে পাথর মারা’র সময় ভিড়ের মধ্যে স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেন ইয়াসির। আজও তার খোঁজ মেলেনি। তবু, স্বদেশে ফেরার ফ্লাইট পিছিয়ে দিয়েছেন এ বৃদ্ধ। আশা করছেন, যেকোনো সময় স্ত্রী ফিরে আসবেন।

ইয়াসিরের মতো পদে পদে দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন অন্য অনিবন্ধিত মিশরীয় হজযাত্রীরাও।

এ বছর মায়ের সঙ্গে হজ করতে গিয়েছিলেন ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ। মিশরীয় এ যুবক বলেন, আরাফাত, মিনা এবং মক্কায় যাওয়ার রাস্তায় মরদেহ পড়ে ছিল। আমি মানুষকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে ক্লান্তিতে মারা যেতে দেখেছি।

আরেক মিশরীয় নাগরিক জানান, হজযাত্রায় তার মা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে তার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি। কিন্তু মৃত্যুর পরেই একটি জরুরি সেবার গাড়ি এসে মরদেহটি অজানা স্থানে নিয়ে যায়।

রিয়াদে বসবাসের কারণে নিজের নামের প্রথম অংশটিও জানাতে রাজি হননি ওই ব্যক্তি। তিনি বলেন, মক্কায় এখনো মায়ের মরদেহ খুঁজছে আমার চাচাতো ভাইয়েরা। তাকে দাফন করার আগে শেষবার দেখার অধিকারও কি নেই আমাদের?

তাসমিম

×