ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মোদীর দুর্গে আঘাত হানা কে এই ধ্রুব রাঠী?

প্রকাশিত: ১২:৪৫, ৯ জুন ২০২৪

মোদীর দুর্গে আঘাত হানা কে এই ধ্রুব রাঠী?

ধ্রুব রাঠী

ধ্রুব রাঠী সেসব ইনফ্লুয়েন্সারের একজন, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেছেন এবং খ্যাতির সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে ব্যাপক সমালোচনারও মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, তার কন্টেন্টগুলোতে ধ্রব প্রায়ই নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি’র সমালোচনা করেন।

ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনের সময় ধ্রুব রাঠীর বানানো ভিডিওগুলো ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। এবছর তিনি বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) ট্রেন্ডে থেকেছেন এবং এক মাস ধরে তিনি সেখানে একটানা ট্রেন্ড করছেন।

আরও পড়ুন : মোদির শপথ কোথায়, আমন্ত্রিত কারা?

এই ধ্রুব রাঠী আসলে কে?
গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়া শুরু করলে ধ্রুব রাঠী তার এক্স অ্যাকাউন্টে লেখেন— ‘নেভার আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব দ্য কমন ম্যান’, অর্থাৎ, ‘সাধারণ মানুষের ক্ষমতাকে হেলাফেলা করবেন না।’

তার ওই পোস্টটি মূলত বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এর একটি সংলাপ। ধ্রুব রাঠী ওই বাক্যটি ভারতের নির্বাচনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একই বিষয় তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ তিনি নিজেও একজন সাধারণ মানুষ। অথচ, তার একেকটি পোস্ট ও ভিডিও মানুষের মনে এতটাই নাড়া দিচ্ছে যে, সবার মুখে মুখে এখন তার নাম।

ধ্রুব রাঠীর পরিচয়
ধ্রুব রাঠী একজন ভারতীয় ইউটিউবার। ইউটিউবে তার প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। ফেসবুকে তার অনুসারীর সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। তার একেকটি ভিডিও কোটি কোটি মানুষ দেখছেন।

ধ্রুব রাঠীর জন্ম হরিয়ানা রাজ্যের রোহতক জেলায়। হরিয়ানা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য জার্মানিতে চলে যান। সেখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি লাভ করেন।

ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ‘ধ্রুব রাঠী ডটকম’-এ ধ্রুব নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি ভিডিও তৈরি করতে পছন্দ করেন। তার ভাষায়, ‘তথ্যবহুল ও শিক্ষামূলক কন্টেন্ট তৈরির মধ্যে আমার দক্ষতা নিহিত; এমন সব কন্টেন্ট, যেগুলোতে বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সুনির্দিষ্ট, সংক্ষিপ্ত ও সহজ ব্যাখ্যা থাকবে।’

তিনি বলেন, আমি আমার ভিডিওর মাধ্যমে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সত্যকে তুলে ধরতে এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, র‍্যাশনালিজম, ক্রিটিক্যাল থিংকিং ও প্রগতিশীল মূল্যবোধ প্রচারে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

‘আমার পড়াশোনা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও রিনিউয়্যাবল এনার্জির ওপর। কিন্তু অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতি আমার গভীর আসক্তি রয়েছে। এ বিষয়ের ওপর আমার দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রিও রয়েছে। এছাড়া, আমি ভ্রমণ করতে পছন্দ করি।’

ইউটিউবে ধ্রুব রাঠীর যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালে। গত বছর পর্যন্ত সেখানে তার সাবস্ক্রাইবার ছিল ১ কোটি ৩০ লাখের মতো। কিন্তু এখন তার প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে এবং এ পর্যন্ত তিনি তার চ্যানেলে ৫০০টির বেশি ভিডিও আপলোড করেছেন।

গত বছর টাইম ম্যাগাজিনের ‘নেক্সট জেনারেশন লিডারস ২০২৩’-এর তালিকায় নাম উঠেছিল ২৯ বছর বয়সী এ ভারতীয় ইউটিউবারের। তিনি তার ‘ফ্যাক্ট-চেকিং’ কাজের জন্য এবং তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিষয়ের ওপর কন্টেন্ট তৈরির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।

গত বছরের মে মাসে বিতর্কিত ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ মুক্তি পাওয়ার পর ধ্রুব রাঠী ছবিটি নিয়ে কথা বলেন এবং ট্রোলিং-এর শিকার হন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ধ্রুব রাঠী সম্পর্কে লিখেছে, লাখ লাখ মানুষের মতো ২০১৪ সালে রাজনীতিতে চলমান দুর্নীতি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীর আবেগময় বক্তৃতা শুনে রুদ্র রাঠীও আশার আলো খুঁজে পেয়েছিলেন। তখন তিনিও মোদীর সমর্থক ছিলেন এবং তার উত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মাথায় মোদীর সমালোচক হয়ে ওঠেন ধ্রুব রাঠী। মোদির বিষয়ে তিনি আশাহত হন ২০১৫ সালে। তখন আম আদমি পার্টি দিল্লিতে একটি দুর্নীতিবিরোধী হেল্পলাইন চালু করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার, মানে মোদী সরকার সেই হেল্পলাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে।

‘এটি আমার জন্য খুব বিস্ময়কর একটি ব্যাপার ছিল, ধ্রুব রাঠী এক সাক্ষাৎকারে আল-জাজিরাকে বলেন। ‘আমি অনুভব করেছি, তারা ভারত থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে আগ্রহী নয়।’

ধ্রুব রাঠীর মতে, যখন তিনি দেখছিলেন, অনেক মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল মোদী ও বিজেপির পক্ষে কথা বলছে, তখন তার হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।

নির্বাচনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছেন?
ধ্রুব রাঠী ও তার কাজ ভারতীয় নির্বাচনের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো, তা বলা কঠিন। তবে গত ৩ জুন, ভোটগণনার একদিন আগে তিনি ‘মাই লাস্ট মেসেজ’ শিরোনামে প্রায় ২৪ মিনিটের দীর্ঘ একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন।

সেই ভিডিওটি এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছে যে, ভারতের নাগরিকরা তা শুধু দেখেননি না, বারবার শেয়ারও করেছেন। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে শিক্ষামূলক কন্টেন্ট তৈরি করতে করতে রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর কন্টেন্ট তৈরি করা শুরু করেছেন।

ধ্রুব রাঠী বলেন, আমি শিক্ষামূলক ভিডিও বানাতে পছন্দ করি, তাই কেবল এটিই করি। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে এমন কিছু বিষয় ঘটে, তারপর আমি আর নিজেকে থামাতে পারিনি। সেসময় চণ্ডীগড় নির্বাচনের জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ও দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন প্রিজাইডিং অফিসার ধরা পড়েন।

‘এরপর আমি সর্বপ্রথম ডিকটেটরশিপের (স্বৈরাচারতন্ত্র) ওপর একটি ভিডিও বানিয়েছিলাম। আমি ভাবিনি যে, এটি কোনো প্রভাব ফেলবে। কিন্তু যখন ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দুই কোটি মানুষ ভিডিওটি দেখেছে এবং বর্তমানে তা আড়াই কোটিতে পৌঁছেছে।’

‘আমি বুঝতে পারলাম, আমি যা অনুভব করছি, আপনারাও ঠিক একই অনুভূতির মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে যেসব বিষয় উদ্বিগ্ন করে তুলছিল, আপনাদেরও একই বিষয় উদ্বিগ্ন করছে। এমনকি, এরপর আমার এ বিষয়ের ওপর আর কোনো ভিডিও বানানোর ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে হয়ে যায়। কারণ এরপর এমন দুটি ঘটনা ঘটে… প্রথমত, অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আটক করা হয় এবং দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়।’

ধ্রুব বলেন, আমি আমার প্রথম ভিডিওতে যা বলেছিলাম, তা সত্য হচ্ছে। এরপরে সিদ্ধান্ত নিলাম, মানুষকে জাগ্রত করতে হবে এবং এই কাজটি পাহাড়ে আরোহণের চেয়েও বেশি কঠিন।

অনেকে ভারতের নির্বাচনী ফলাফলে ধ্রুব রাঠির ভিডিওগুলোর প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ধ্রুব বলেন, তার মতো আরও অনেকে রয়েছেন, যারা নির্ভয়ে তাদের কাজ করছেন।

এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি ভারতের সুপরিচিত সাংবাদিক রাভিশ কুমার, আভিসার শার্মা, আজিত আঞ্জুমের কথা উল্লেখ করেছেন। পুনম আগরওয়াল, মানীষা পান্ডে, নিধি সুরেশ এবং আরিফা খানম শেরওয়ানি, মীনা কোতওয়াল, ড. মেডুসাসহ গোলা, কাবিরন, গ্রিমা, নেহা সিং রাঠোরের মতো মানুষের কথাও বলেন ধ্রুব।

মনসুর নামক এক ব্যক্তি ধ্রুব রাঠীর ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, হাওয়া বদল করে দেওয়া ভারতীয় নায়কের সঙ্গে পরিচিত হোন, যিনি একাই মোদীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

সাবেক সাংবাদিক আকাশ ব্যানার্জী তার ‘দ্য দেশ ভক্ত’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ধ্রুব রাঠীর স্বৈরাচারের ভিডিওটি সম্পর্কে বলেন, এটি সরাসরি সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে। সেই ভিডিওটি লাখ লাখ মানুষ দেখলেও তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

আকাশ ব্যানার্জির মতে, ভিডিওতে ‘স্বৈরাচার’ শব্দটির ব্যবহার এটিকে বিশেষ করে তুলেছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা


 

তাসমিম

সম্পর্কিত বিষয়:

×