রোমানিয়ায়র ভিসা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নবম বৃহত্তম আয়তনের দেশ রোমানিয়া। এ দেশে রয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। রয়েছেন সিলেটিরাও। রোমানিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের অনেকের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের আনা যায় কিনা তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো বাংলাদেশি বলছেন, রোমানিয়াতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ।
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টের কাছেই একটি প্যাকেজিং কোম্পানিটিতে বর্তমানে হেড অব প্রোডাকশন হিসাবে আছেন বাংলাদেশি তরুণ তোফায়েল আহমেদ ভূঁইয়া। গত পাঁচ বছর ধরে এখানেই কাজ করছেন তিনি৷ তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন রোমানিয়ায়।
তোফায়েল জানালেন, রোমানিয়ায় বৈধ ভিসা নিয়ে একজন ব্যক্তি আসার কিছুদিন পর অস্থায়ী বসবাসের অনুমতির (টিআরসি) জন্য আবেদন করতে হয়৷ ওই কার্ড পাওয়ার পর একজন অভিবাসী রোমানিয়ার স্থানীয় নাগরিকদের কাছাকাছি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার অর্জন করেন৷ ফলে যাদের বৈধ টিআরসি কার্ড আছে এবং যারা এ দেশে ন্যূনতম মজুরি (তিন হাজার তিনশ লিউ বা প্রায় ৮০ হাজার টাকা) পান এবং বাসা ভাড়ার প্রমাণ থাকে তাহলে অবশ্যই পরিবারের সদস্য আনা যাবে।
প্রক্রিয়া সহজ হলেও বাংলাদেশিদের পরিবার নিয়ে আসার প্রবণতা কম। অনেকে সঠিক তথ্য জানেন না বলে পরিবারের সদস্যদের আনতে পারেন না বলে মনে করেন তোফায়েল৷ আবার অনেক বাংলাদেশি রোমানিয়া ছেড়ে ইউরোপের অন্য দেশে চলে যেতে চান বলে পরিবার আনার ক্ষেত্রে অতোটা আগ্রহ দেখান না।
তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়াটি এখানে এতো সহজ, আমার মনে হয় অন্য কোনো দেশে এতো সহজ না। তবে তথ্যগত জটিলতার কারণে যারা পরিবারের সদস্যদের নিজের কাছে আনতে পারছেন না তাদের বুখারেস্টে বাংলাদেশি দূতাবাসের সহযোগিতা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীরা।
রোমানিয়ায় আসার কারণ সম্পর্কে তোফায়েল বলেন, পড়ালেখা করেও দেশে কাজ পাচ্ছিলাম না৷ ২০১৯ সালে দেখলাম এই দেশে জনশক্তির প্রয়োজন রয়েছে৷ আসা যাচ্ছে। অ্যাপ্লাই করে খুব ইজিতে ভিসা পাওয়া গেছে৷ সেজন্য আসছি৷ আসার পর দেখলাম পরিবেশ খুব ভালো। এখানে কোনো রকম কোনো সমস্যা ফিল করিনি, টিল নাউ৷ সেজন্য থেকে গেছি।
গত ৩১ মার্চ থেকে ভিসামুক্ত অবাধ যাতায়াতের শেঙেন জোনে অন্তুর্ভুক্তি পেয়েছে রোমানিয়া৷ প্রাথমিকভাবে আকাশপথে ও জলপথে এই সুবিধা পাচ্ছে দেশটি৷ স্থলপথে অনুমতির জন্য আরো অপেক্ষায় থাকতে হবে রোমানিয়াকে।
সেনজেন অন্তর্ভুক্তি রোমানিয়ার অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দু ধরনের প্রভাবই ফেলতে পারেন বলে মনে করেন তোফায়েল। তিনি বলেন, এর আগে ইউরোপের অন্য দেশে ঘুরতে যেতে চাইলে ভিসার আবেদন করতে হতো৷ দূতাবাসগুলো আবেদন প্রত্যাখ্যান করতো৷ এখন সুবিধা হলো, ছুটি পেলে ঘুরতে যাওয়া যাবে।
তিনি আরো বলেন, এখানে বাংলাদেশি যারা আসেন, রোমানিয়া এসেই তাদের উদ্দেশ্য থাকে ইউরোপের অন্যদেশগুলোতে মুভ করব৷ তাদের ভিসাতেও এখন শেঙেন ভিসা দেয়া হচ্ছে৷ সো তারা চাইলে ইজিতে মুভ করতে পারতেছে। কিন্তু এর সমস্যা হলো, যখনই একটি দেশে কর্মী দরকার তখনই ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে৷ কর্মী যদি এসে চলে যায় অন্য দেশে, সেটার কিন্তু ব্যাড ইমপেক্ট পড়ে৷ সে কারণে আমাদের (বাংলাদেশিদের) সংখ্যা অনেক কমে গেছে, ভিসা পাওয়ার হারটা।
কর্মীদের ধরে রাখতে বেশকিছু রোমানীয় প্রতিষ্ঠান বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে বলে জানালেন এই বাংলাদেশি। তিনি বলেন, তারাও বুঝতে পারছে যে বেতন-ভাতা বাড়ানো না হলে কর্মীরা চলে যেতে পারে।
গত তিন মাস ধরে এই কারখানাতেই কাজ করছেন তোফায়েলের স্ত্রী ফৌজিয়া৷ নিজের সার্বিক অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্টি জানালেন তিনি। বললেন, সবমিলিয়ে রোমানিয়াতে ভালো সময় কাটছে তার। নিজের কাজ নিয়ে তিনি বললেন, আমি তো এখনও নতুন৷ আমি শিখছি৷ যতটুকু করতেছি, ভালোই লাগতেছে।
গত তিন মাস ধরে এই কারখানাতেই কাজ করছেন বাংলাদেশি নারী অভিবাসী ফৌজিয়া। পণ্যের গুণগত মান যাচাই করেন তিনি। বললেন, সবমিলিয়ে রোমানিয়াতে ভালো সময় কাটছে তার।
গত দুই বছর ধরে প্যাকেজিং কারখানাটিতে কাজ করেন বাংলাদেশি নাগরিক হামিদুর রহমান। এজেন্সি বা তৃতীয় পক্ষের কোনো সহযোগিতা ছাড়া সরাসরি এসেছিলেন তিনি৷ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বললেন, ‘আমাদের সবকিছু ঠিক আছে। বেতনও আমরা টাইম মতো পাই, কাজও ঠিকা আছে।’ কারখানা মালিকই তার আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন। এর বাইরে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ হাজার টাকা বেতন পান তিনি৷ তবে খাবার-দাবারের খরচ নিজেকে বহন করতে হয়।
রোমানিয়া ছেড়ে ইউরোপের অন্য দেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হামিদুরের নেই। তিনি বলেন, ‘অবৈধ পথে (অনিয়মিতভাবে) কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’
সাভারের হেমায়েতপুর ছেড়ে রোমানিয়ায় এসেছেন বাংলাদেশি যুবক আদালত হোসেন। ইউরোপে আরো অনেক দেশ থাকলেও জীবিকার জন্য রোমানিয়াকে বেছে নেয়ার কারণটা জানালেন তিনি। আদালত বলেন, ‘রোমানিয়াতে এই কারণে আসছি, এখানে প্রথমে আসা সুবিধা ছিল, সহজ উপায়ে ভিসা পাইছি। ওই হিসাবে আসছি, আইসা ভালো লাগছে, থাইকা গেছি।’
পাঁচ বছরের ধরেই এই কারখানায় কাজ করছেন হামিদুর। তিনি বলেন, ‘এখানেই (কর্মরত প্রতিষ্ঠান) আমার জন্য ভালো, সেজন্য এখানেই রয়ে গেছি৷ স্যালারি ঠিক মতো দিয়ে দেয়, আমি কোনো ভোগান্তির শিকার হইতেছি না।’
জীবিকার তাগিদেই বাংলাদেশ ছেড়ে বছর দুয়েক আগে রোমানিয়া এসেছেন শাকিল। রোমানিয়ায় কিছু বাংলাদেশি শ্রম শোষণ কিংবা মালিকপক্ষের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, যারা একটি বৈধ কোম্পানিতে আসেন, তাদের সঙ্গে একটা কন্ট্রাক্ট থাকে এক বছর বা দুই বছরের৷ কিন্তু কন্ট্রাক্টের আগে যদি কেউ চলে যেতে চায়, যেমন: আপনি তিন মাস কাজ করেছেন বা ছয় মাস কাজ করেছেন, এরপর আপনি যদি চলে যেতে চান, তাহলে মালিকপক্ষ কোনোভাবে রাজি হবেন না আপনাকে রিলিজ লেটার বা এনওসি দেয়ার জন্য৷ যতোদিন রিলিজ লেটার বা এনওসি না দেবে, ততোদিন আপনি অন্য কোম্পানিতে যাইতে পারবেন না৷ আপনি নিজ ইচ্ছায় যদি চলে যান, অন্য কোনো কোম্পানিতে কাজ করতে পারবেন না।
বাংলাদেশি কর্মীদের অনেকের মধ্যে শিক্ষার ঘাটতি, অসচেতনতা, ঠিকমতো নিয়ম কানুন এবং আইন সম্পর্কে না জানার কারণে ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার শিকার হন বলে মনে করেন শাকিল।
এই ইস্যুতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম জানিয়েছে, কোনো বাংলাদেশি কর্মী যদি শ্রম শোষণের শিকার হয়, তাদেরও অবশ্যই একজন রোমানীয় নাগরিকের মতো প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে।
এম হাসান