ক্যাপ : আহমাদ আল-ঘুফেরি ও তার তিন কন্যা– তালা, লানা এবং নাজলা।
যে বোমাটির হাত থেকে আহমাদ আল-ঘুফেরি বেঁচে গেছেন, সেটি তার পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
গাজা শহরে তার বাড়িতে হওয়া এই বোমা হামলায় তার পরিবারের মোট ১০৩ জন সদস্য নিহত হন। এই হামলার সময় তিনি গাজা শহর থেকে ৫০ মাইল (৮০ কিলোমিটার) দূরের দখলকৃত জেরিকো’র পশ্চিম তীর শহরে আটকা পড়েছিলেন।
গত সাতই অক্টোবর হামাস যখন ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করে, তখন তেল আবিবের একটি কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করছিলেন। হামাসের ঐ হামলার পর যুদ্ধ বেধে যাওয়াতে এবং ইসরায়েলের সামরিক অবরোধের কারণে তিনি তার স্ত্রী ও তিন শিশু কন্যার কাছে ফিরতে পারছিলেন না।
তিনি প্রতিদিন একই সময়ে তাদের সাথে কথা বলছিলেন, যখন ফোন সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং 8 ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলার সময় তার স্ত্রী শিরিনের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন।
তবে যতদিন পর্যন্ত ফোনে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি ছিলো, ততদিন পর্যন্ত তিনি তাদের সাথে নিয়মিত কথা বলতেন। গত চৌঠা ডিসেম্বর যখন তার বাড়িতে হামলাটি ঘটে, সেদিনও তিনি তার স্ত্রী শিরিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন।
“ও (শিরিন) জানতো, ও মারা যাবে,” আহমাদ বলেন। “ও আমায় বলেছিলো, আমার সাথে ও যদি কখনও খারাপ কিছু করে থাকে, তাহলে আমি যেন ওকে ক্ষমা করে দেই। আমি ওকে বলেছিলাম যে এটা বলার কোনও দরকার নেই। এটাই ছিলো আমাদের দু’জনের মাঝে শেষ কথোপকথন।”
সেই সন্ধ্যায় আহমাদের চাচার বাড়িতে একটি বড়সড় বোমা হামলা হয় এবং তাতে তার স্ত্রী এবং তিন কন্যা– তালা, লানা এবং নাজলা নিহত হয়।
এতে আহমাদের মা, তার চার ভাই ও ভাইদের পরিবার, সেই সাথে কয়েক ডজন ফুফু, চাচা ও চাচাতো ভাই-বোনও নিহত হন। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা শতাধিক।
হামলার পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও ধ্বংসস্তূপের নীচে এখনও কিছু লাশ আটকে আছে।
গত সপ্তাহে ছিলো তার ছোট মেয়ে নাজলা’র জন্মদিন। বেঁচে থাকলে নাজলা দুই বছরে পা রাখতো। আহমাদ এখনও এই অপূরণীয় ক্ষতিতে ধাতস্থ হতে চেষ্টা করছে।
তার কন্যাদের মৃতদেহ তিনি ধরতে পারেননি। এমনকি তাড়াহুড়ো করে যখন তাদের মৃতদেহ দাফন করা হয়, তখনও তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
তিনি তার মেয়েদের বিষয়ে এখনও এমনভাবে কথা বলেন, যেন মনে হয় যে তারা বেঁচে আছে। যদিও কথা বলার সময় তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে।
তিনি বলেন, “আমার মেয়েরা আমার কাছে ছোট্ট পাখি। আমার মনে হয়, আমি কোনও স্বপ্নের মাঝে আছি। আমাদের সাথে যা হয়েছে, সেটিকে আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।”
তিনি তার মোবাইল এবং ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মেয়েদের ছবি সরিয়ে নিয়েছেন, যাতে এটা নিয়ে আবার তারা অতর্কিতে হামলা না করে।
তার যে ক’জন আত্মীয় এবং প্রতিবেশী বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন যে হামলার দিন ঠিক কী কী হয়েছিলো। সেটা শুনে তিনি মনে মনে ঐদিনের একটি চিত্র দাঁড় করিয়েছেন।
তারা তাকে বলেছেন যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে সর্বপ্রথম আঘাত তার পারিবারিক বাড়ির প্রবেশদ্বারে।
"তারা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে ঠিক পাশেই আমার চাচার বাড়িতে যায়," তিনি বলেন। "তার ঠিক পনের মিনিট পরে একটি যুদ্ধবিমান ওই বাড়িতে আঘাত হানে।"
গাজা শহরের জেইতুন পাড়ার সাহাবা মেডিকেল সেন্টারের কোণে অবিস্থিত ঐ চারতলা বাড়িতে এই পরিবারটিকে হত্যা করা হয়েছিলো।
এই বাড়িটি এখন শুধুই কংক্রিটের একটি ঢিবিতে পরিণত হয়েছে। এই ধ্বংসস্তূপের ওপর উজ্জ্বল রঙ্গের পাথর, সবুজ প্লাটিকের কাপ এবং ছিন্নবিচ্ছিন্ন ধুলাময় কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আহমাদের একজন আত্মীয় হামিদ আল-গুফেরি বিবিসিকে বলেন যে হামলা শুরু হওয়ার পর যারা পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো, তারা বেঁচে গেছেন। কিন্তু বাড়িতে আশ্রয় নেয়াদের সবাই নিহত হয়েছেন।
“এটি ছিলো একটি ফায়ার বেল্ট (একটি স্থানে যখন অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ফেলা হয়),” তিনি বলেন।
“আমাদের পাশের আরও চারটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। প্রতি দশ মিনিটে একেকটি বাড়তে হামলা হয়।”
“ঘুফেরি পরিবারের ১১০ জন সদস্য এই বাড়িগুলোয় ছিলো–এরা আমাদের সন্তান এবং স্বজন। কিন্তু গুটিকয়েক বাদে এদের সবাইকে হত্যা করা হয়,” তিনি বলেন।
যারা বেঁচে গিয়েছেন, তারা বলেন যে এই হামলার সবচেয়ে বয়স্ক শিলার ৯৮ বছর বয়সী একজন দাদী এবং সবচেয়ে কনিষ্ঠ ভুক্তভোগী হলো একজন শিশু; মাত্র নয়দিন আগে যার জন্ম হয়েছিলো।
আহমাদের একজন চাচাতো ভাই, যার নামও আহমাদ; তিনি একটি বিমান হামলা থেকে দু’টি বড় বিস্ফোরণ হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। “কোনও আগাম সতর্কবার্তা ছিলো না,” তিনি বলেন।
"কিছু মানুষ যদি আগেই এই এলাকা ছেড়ে চলে না যেত, তাহলে শত শত মানুষ মারা যেত বলে আমি মনে করি। এলাকাটি এখন একেবারেই অন্যরকম দেখাচ্ছে। এখানে একটি গাড়ি পার্ক করার জায়গা ছিলো, পানি রাখার জায়গা ছিলো এবং তিনটি বাড়ি ছিলো, বাড়িগুলোর মাঝে একটি বাড়ি বেশ বড় ছিলো। কিন্তু এই পুরো আবাসিক এলাকাটি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে।”
"বিমানগুলি আকাশে ঘুরছিল এবং আমরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করায় কোয়াড কপ্টারগুলি (একধরনের হেলিকপ্টার, যার চারটি টার্বাইন থাকে) আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল," চাচাতো ভাই আহমাদ বলেছিলেন।
উম্ম আহমাদ আল-ঘুফেরি বিবিসিকে বলেন, "আমরা ঘরে বসে ছিলাম এবং আমরা নিজেদেরকে ধ্বংসস্তূপের নীচে আবিষ্কার করলাম। আমাকে একপাশ থেকে অন্য পাশে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো। আমি জানি না, কিভাবে তারা আমাকে বের করে এনেছে। আমরা আমাদের চোখের সামনে মৃত্যু দেখেছি।"
হামলার পর আড়াই মাস হয়ে গেলেও তারা এখনও ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে থাকা কিছু লাশের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। কিছু টাকা জোগাড় করে তারা একটি ছোট খনন মেশিন ভাড়া করেছে, ধ্বংসস্তূপ সরানোর জন্য।
আহমাদ বিবিসিকে বলেন, "আমরা [আজ] চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি; যার মধ্যে আমার ভাইয়ের স্ত্রী এবং আমার ভাগ্নে মোহাম্মদ ছিলো, যাদেরকে টুকরো টুকরো করে বের করা হয়েছিলো। তারা ৭৫ দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিলো।"
কাছাকাছি একটি খালি জমিতে তাদেরকে কবর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো লাঠি এবং প্লাস্টিকের চাদর দ্বারা চিহ্নিত।
জেরিকোতে আটকে পড়া আহমাদ তাদেরকে দেখতে যাননি।
"আমার মা, আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এবং আমার ভাইদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো কী করেছি আমি?" তিনি জানতে চান। "তারা সবাই বেসামরিক ছিলো।"
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে ঘুফেরি পরিবারের অভিযোগ সম্পর্কে জানিয়েছে বিবিসি। জবাবে সেনাবাহিনী বলেছে যে এই হামলা সম্পর্কে সচেতন ছিল না এবং ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হামাসের সাথে তার যুদ্ধে 'বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সম্ভাব্য সতর্কতা' নিয়েছে।
আহমাদের পরিবারের ওপর হামলার আগের ও পরের দিনগুলোতে আল-ঘুফেরি বাড়ির দক্ষিণে শেজাইয়া এলাকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং হামাসের বন্দুকধারীদের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়েছিলো।
নয়ই ডিসেম্বর একটি দৈনিক আপডেটে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলে যে তারা "অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইলে (ট্যাঙ্ক-বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র) সজ্জিত বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করেছিলো", যারা শেজাইয়াতে সৈন্যদের দিকে আসছিলো। সেজন্যই তারা তাদের উপর একটি হেলিকপ্টার হামলার ডাক দিয়েছিলো।
এটি আরও বলেছে যে যেহেতু স্থল অভিযান চলমান রয়েছে, তাই যুদ্ধবিমানগুলো গাজা উপত্যকায় সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
জেইতুন এর এই এলাকা, যেখানে একসময় একটি পারিবারিক বাড়ি ছিলো, সেটি এখন আইডিএফ-এর অভিযানের নতুন কেন্দ্রবিন্দু।
জেরিকোতে থাকা আহমাদ এখনও মাঝে মাঝে গাজায় বেঁচে থাকা তার আত্মীয়দের কাছে ফোন করেন। কয়েক মাস ধরে প্রিয় বাড়ি ছেড়ে দূরে আটকা পড়া আহমাদ তার বাড়িতে ফিরে আসার জন্য মরীয়া আছেন।
তবে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন যে তিনি আর কখনও ঐ বাড়িতে ফিরবেন কি-না।
"গাজায় আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে," তিনি বলেন।
"আমি কার জন্য ফিরে যাবো? কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে? কে আমায় প্রিয়তম বলে ডাকবে? আমার স্ত্রী আমায় বলতো, তার গোটা জীবন জুড়ে শুধুই আমি। এখন কে আমায় এ কথা বলবে?"
সূত্র: বিবিসি
এস