ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

আসক্তি কমাতে এক গ্রামে বন্ধ টেলিভিশন-মুঠোফোন

প্রকাশিত: ২২:১৭, ১১ অক্টোবর ২০২২

আসক্তি কমাতে এক গ্রামে বন্ধ টেলিভিশন-মুঠোফোন

টেলিভিশন দেখছে শিশুরা

মুঠোফোন ও টেলিভিশনের হাত থেকে দেড় ঘণ্টা মুক্তি পেতে ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করেছে ভারতের একটি গ্রাম। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় গ্রামের একটি সাইরেন বাজানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সবার ঘরের টেলিভিশন ও মুঠোফোন। রাত সাড়ে আটটায় আবার সাইরেন বাজে। এর মানে হলো, এবার টেলিভিশন ও মুঠোফোন চালু করা যাবে। 

গ্রামটির নাম ভাদগাঁও। এটি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের সাংলি জেলায় অবস্থিত। গ্রামে প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস। অধিকাংশই কৃষক ও চিনি কারখানার শ্রমিক।

গ্রাম পরিষদের সভাপতি বিজয় মোহিত বলেন, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন গত ১৪ আগস্ট আমরা গ্রামে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের এই আসক্তি বন্ধ করতে হবে। পরদিন থেকে সাইরেন বাজিয়ে সব টেলিভিশন ও মুঠোফোন বন্ধ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারির কারণে ছেলে-মেয়েরা টেলিভিশন ও মুঠোফোনে অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে ফিরে যায়। কিন্তু সেখান থেকে ফিরেই ছেলে-মেয়েরা মুঠোফোন নিয়ে বসে পড়ে বা টিভি দেখে। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও নিজেদের মধ্যে কথা না বলে এসব ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

বন্দনা নামের এক নারী বলেন, দুই ছেলে-মেয়েকে সামলানো তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, তারা মুঠোফোনে খেলা নিয়ে বা টেলিভিশন দেখতেই ব্যস্ত থাকত। নতুন এই ব্যবস্থা চালুর পর তার অনেক সুবিধা হয়েছে বলে দাবি করেন বন্দনা। এখন তার স্বামী কাজ থেকে ফিরে ছেলে-মেয়েকে পড়াতে পারেন। আর তিনিও রান্নার কাজটি ভালোভাবে সারতে পারেন।

কিন্তু গ্রাম পরিষদের জন্য এই সিদ্ধান্তে আসতে সবাইকে একমত করানো খুব সহজ ছিল না। বিজয় মোহিত বলেন, যখন প্রাথমিকভাবে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন অনেকের কাছেই মনে হয়েছে এ যেন দম বন্ধের অবস্থা। এরপর গ্রাম পরিষদ গ্রামের নারীদের জড়ো করে। তারা অনেক বেশি সিরিয়াল দেখলেও এ প্রস্তাবের পক্ষে সায় দেন। এরপর গ্রামে আরেকটি বৈঠক করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রামের মন্দিরের ওপর সাইরেন বসানো হবে।

এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ ছিল না। শুরুর দিকে যখন সাইরেন বাজত, তখন পরিষদের সদস্যরা ও গ্রামের কয়েকটি ছোট ছোট দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে টেলিভিশন ও মুঠোফোন বন্ধ করতে আহ্বান জানাত।

বিজয় মোহিত বলেন, এখন পুরো গ্রামেই এটি কার্যকর হয়েছে।

কিন্তু এত অল্প সময় টেলিভিশন ও মুঠোফোন বন্ধ রাখলে কি কোনো সুফল পাওয়া যাবে? এর জবাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক ড. মনোজ কুমার শর্মা বলেন, করোনার সময়টিতে মানুষের মধ্যে অনলাইনে সময় কাটানোর পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। 

ড. শর্মার ও তার সহকর্মীরা ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৮২ জনের (৪৯৫ জন নারী ও ১৮৭ জন পুরুষ) ওপর জরিপ চালান। সেখানে দেখা গেছে, কিশোর, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে- সমস্যায় রূপ নিতে পারে ইন্টারনেটের এমন ব্যবহার—এর ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার ফলে উদ্ভূত সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি।

গবেষণায় পাওয়া গেছে, অকাজে ইন্টারনেটের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে সমস্যা তৈরির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এতে কৈশোরকালের অনেক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

কিশোর-কিশোরীরা মনস্তাত্ত্বিক চাপ থেকে সাময়িকভাবে বাঁচতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এতে তারা ব্যক্তিগত সামাজিক মেলবন্ধন, পারিবারিক মেলবন্ধন এবং পাঠ্যক্রমের বাইরের গঠনমূলক বিষয়গুলো থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

ড. শর্মা মনে করেন, মানসম্পন্ন কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত করতে পরিবারের ‘ডিজিটাল উপবাস’ একটি সচেতনতা। এটি অনলাইন কার্যক্রমের ওপর নির্ভরতা কমানোর একটি ভিত্তি। অভিভাবক হিসেবে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন আছে। তাদের শারীরিক বা অফলাইন অবসর কার্যক্রমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম এবং খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

ভাদগাঁও গ্রামের দিলীপ মোহিত। তিনি একজন আখশ্রমিক। বলেন, স্কুলগামী তার তিন ছেলে রয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে তিনি পরিবর্তনটা দেখতে পারছেন। ছেলে-মেয়েরা এখনকার মতো আগে পড়াশোনায় এতটা মনোযোগী ছিলেন না। এখন বাড়িতে সবার মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়।

সূত্র: বিবিসি

এসআর

×