ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

জাপানে নিজের জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া খুব সহজ

প্রকাশিত: ১০:৪০, ১৫ জুলাই ২০২১

জাপানে নিজের জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া খুব সহজ

অনলাইন ডেস্ক ॥ যুক্তরাষ্ট্র থেকে জার্মানি, জার্মানি থেকে যুক্তরাজ্য - সারা বিশ্বেই কিছু কিছু মানুষ আছে যারা তাদের নিজের জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বাড়িঘর, চাকরি বাকরি এবং পরিবার থেকেও মাঝ রাতে তারা এমনভাবে উধাও হয়ে যায় যাতে কেউ তাদের খুঁজে বের করতে না পারে। এর পর তারা শুরু করে নতুন জীবন, অনেক সময় তারা আর পিছনে ফিরেও তাকায় না। জাপানে এধরনের লোকজনকে অভিহিত করা হয় "জুহাতসু" হিসেবে। এই জাপানি শব্দের অর্থ বাষ্পীভবন বা হাওয়া হয়ে যাওয়া। যেসব লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে লুকোতে চায় তাদেরকে বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই লোকগুলো কোথায় আছে এবং কী করছে সেসব তারা গোপন রাখে - কখনও কখনও কয়েক বছর এমনকি কয়েক দশকের জন্যও। "মানুষের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ি। এর পর ছোট্ট একটি সুটকেস নিয়ে আমি উধাও হয়ে যাই। এক ধরনের পালিয়ে যাওয়াও বলতে পারেন," বলেন ৪২-বছর বয়সী সুগিমোতো, পরিচয় গোপন রাখার জন্য এখানে তার আসল নাম উল্লেখ করা হয়নি। সুগিমোতো বলেন, যে ছোট্ট শহরে তিনি ছিলেন তার পরিবারের কারণে সেখানে সবাই তাকে চিনতো। কারণ তাদের ব্যবসা স্থানীয় লোকজনের কাছে বেশ পরিচিত ছিল। পরিবারটি আশা করছিল যে সুগিমোতো এই ব্যবসার হাল ধরবেন। কিন্তু এই দায়িত্ব নিয়ে সুগিমোতো এমন চাপের মধ্যে পড়েন যে তার মধ্যে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয় এবং তিনি খুব দ্রুত চিরদিনের জন্য ওই শহরে ছেড়ে চলে যান। কোথায় যাচ্ছেন সে কথাও কাউকে বলেন নি। এভাবে হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ পরিশোধ করার মতো নয় এমন ঋণ থেকে শুরু করে প্রেমহীন বিবাহ। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, তারা তখন এমন কিছু কোম্পানির দ্বারস্থ হন যারা তাদেরকে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে। এধরনের কাজকে বলা হয় "রাতে সরে যাওয়ার" সার্ভিস। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে "জুহাতসু" হয়ে যাওয়ার গোপন প্রক্রিয়াকেই অনুমোদন করা হয়। যেসব লোকজন উধাও হতে চান তাদেরকে গোপনে জীবন থেকে সরে যেতে সাহায্য করে এসব কোম্পানি। এমনকি গোপন স্থানে তাদের থাকারও ব্যবস্থা করে দেয়। "সাধারণত এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে ইতিবাচক কারণই থাকে, যেমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, কোথাও নতুন চাকরি পাওয়া অথবা কাউকে বিয়ে করা।" "তবে খারাপ কিছু কারণও থাকে- উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, চাকরি হারানো অথবা কারো কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া," বলেন শো হাতোরি, যিনি ৯০-এর দশকে, পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে এরকম একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই দশকে জাপানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন লোকজন হয়তো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণেই তাদের সমস্যা-কবলিত জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে, কিন্তু খুব শীঘ্রই তিনি দেখতে পান যে এর পেছনে আরো কিছু সামাজিক কারণও রয়েছে। "মানুষ যাতে আরেকটা দ্বিতীয় জীবন শুরু করতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যই আমরা এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছি," বলেন তিনি। সমাজবিজ্ঞানী হিরোকি নাকামোরি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লোকজনের এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তাদের ব্যাপারেই প্রথম "জুহাতসু" শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় জীবন: জাপানে বিবাহ বিচ্ছেদের হার খুব কম ছিল, এখনও কম। ফলে অনেকেই ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একদিন হঠাৎ করেই তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায়। "জাপানে উধাও হয়ে যাওয়া খুব সহজ," বলেন নাকামোরি। দেশটিতে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিরা তাদের পরিচয় না দিয়েও মুক্তভাবে এটিএম থেকে অর্থ তুলতে পারেন। এছাড়াও পালিয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি যদি গোপন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো ক্যামেরাতে ধরাও পড়েন, তার পরিবারের সদস্যদের ওই ভিডিও দেখতে দেওয়া হয় না। "অন্য কোনো কারণ না থাকলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না- যেমন কোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনা। পরিবারগুলো চাইলে হয়তো ব্যক্তিগত গোয়েন্দাদের অর্থ দিয়ে কাজে লাগাতে পারে। অথবা পারে শুধু অপেক্ষা করতে। এর বাইরে কিছু করার নেই।" এক মায়ের গল্প: পরিবারের সদস্য কিম্বা প্রিয় ব্যক্তিরা নিখোঁজদের খোঁজে কাজ শুরু করলেও সেটা বেশি দিন চালিয়ে নেওয়া যায় না। "আমি ভেঙে পড়ি," বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী, যার ২২-বছর বয়সী এক ছেলে উধাও হয়ে গেছে এবং তার পর থেকে মায়ের সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেনি। "সে দু'বার তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আর পরছিল না। এই ব্যর্থতার কারণে তার জীবন হয়তো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল," বলেন তিনি। ছেলে যেখানে থাকতো তার খোঁজে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, সবখানে খুঁজে দেখেছেন এবং ছেলে ফিরে আসবে এই আশায় কয়েকদিন ধরে গাড়িতে বসে অপেক্ষাও করেছেন। কিন্তু সে আর ফেরেনি। তিনি বলেন, পুলিশ তাকে খুব একটা সাহায্য করেনি। তিনি জানান পুলিশ তাকে বলেছে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করলেই কেবল পুলিশ এর সাথে জড়িত হতে পারে। কিন্তু এবিষয়ে কোনো নোটও ছিল না এবং পুলিশও তাকে পরে সাহায্য করেনি। "আমি জানি যে খারাপ লোকও আছে- তথ্যের অপব্যবহারও হতে পারে। এটা একটা প্রয়োজনীয় আইন। কিন্তু অপরাধী, খারাপ লোক কিম্বা পিতামাতা যারা তাদের সন্তানের খোঁজ করছে, নিরাপত্তার কারণে তাদের সবার সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করা হচ্ছে," বলেন তিনি। "বর্তমান আইন অনুসারে, টাকা দিয়ে আমি একটা কাজই করতে পারি। আর তা হলো কোনো মৃতদেহ পাওয়া গেলে সেটি আমার ছেলের কীনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা- এই কাজটাই আমার করা বাকি।" নিখোঁজ ব্যক্তির কথা: যারা উধাও হয়ে যাচ্ছেন, পরিবার ছেড়ে চলে আসার বহু দিন পরেও দুঃখ এবং অনুতাপ থেকে তারা মুক্তি পান না। "সারাক্ষণ আমার মনে হয় যে আমি কিছু একটা ভুল করেছি," বলেন সুগিমোতো, একজন ব্যবসায়ী যিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ছোট্ট একটি শহরে ফেলে এসেছেন। "এক বছরের মধ্যে আমি আমার সন্তানদের দেখি নি। তাদেরকে বলে এসেছি যে আমি ব্যবসার কাজে যাচ্ছি।" তিনি বলেন তার একমাত্র অনুতাপ হচ্ছে যে তিনি তাদেরকে ছেড়ে চলে এসেছেন। টোকিওরই একটি আবাসিক এলাকার বাড়িতে আছেন তিনি। যে কোম্পানিটি তাকে এই বাড়ি খুঁজে দিয়েছে সেটি পরিচালনা করেন সাইতা নামের এক নারী। তার নামও এখানে গোপন করা হয়েছে। তিনি নিজেও এরকম নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন। ১৭ বছর আগে তিনি উধাও হয়ে যান। সাইতা বলেন, তিনি এমন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন যেখানে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। একারণে তিনি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছেন, "এক অর্থে আমিও একজন নিখোঁজ ব্যক্তি, এখনও।" "আমার নানা ধরনের মক্কেল আছে," বলেন তিনি। "পরিবারের ভেতরে বড় ধরনের নির্যাতন হচ্ছে- এরকম পরিবেশ থেকেও লোকেরা পালিয়ে আসছেন, অহংবোধ এবং নিজের স্বার্থেও অনেকে পালিয়েছেন। আমি তাদের বিচার করি না। আমি কখনো বলি না যে তোমার ঘটনাটা গুরুতর কিছু নয়। প্রত্যেকের সংগ্রাম আলাদা।" তার কোম্পানি সুগিমোতোর মতো পালিয়ে আসা লোকজনকে তাদের বিপদে আপদে সাহায্য করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি উধাও হয়ে যেতে পারলেও তার অর্থ এই নয় যে তার আগের জীবনের কোনো আলামত বা চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। "একমাত্র আমার প্রথম সন্তান সত্যটা জানে। তার বয়স ১৩। যে কথাগুলো আমি ভুলতে পারি না তা হচ্ছে, সে বলেছিল: 'পিতা যেটা বেছে নিয়েছে সেটা পিতার জীবন, এবং আমি তো সেটা পরিবর্তন করতে পারবো না।' তার এই কথা তো আমার চেয়েও পরিপক্ব, তাই না?" সূত্র : বিবিসি বাংলা
×