রুশ তেলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাজে আসেনি
ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার জেরে পশ্চিমাদের একাধিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল রাশিয়া। একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কারণে সাময়িক সংকটের মুখে পড়ে দেশটির তেল ও গ্যাস শিল্প। তবে রপ্তানির জন্য ইউরোপের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে সুলভ মূল্যে তেল ও গ্যাস রপ্তানির দিকে ঝোঁকে দেশটি। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত সাপে বর হয়ে দাঁড়ায়।
এই শিল্প থেকে আশাতীত মুনাফা অর্জন করতে শুরু করে দেশটি। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই শিল্প থেকে গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনের রেকর্ডও গড়েছে রাশিয়া, যা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে গেছে। খবর স্কাই নিউজের।
যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই কীভাবে রাশিয়া তার তেল ও গ্যাস নতুন ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজের অর্থনীতি এবং তথ্য বিষয়ক সম্পাদক। বুধবার এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাধিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও এখন পর্যন্ত এই শিল্প থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে চলেছে দেশটি।
এর অন্যতম কারণ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিকে নির্দেশ করা হয়েছে। রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো তেল, গ্যাস ও কয়লা রপ্তানিতে দেশটিকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার ভূগোল পরিবর্তন করে দিয়েছে পশ্চিমারা।
এ বিষয়ে ব্লুমবার্গের সংগৃহীত পরিসংখ্যানগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন স্কাই নিউজের বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যে তারা দেখতে পেয়েছেন, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত তিন মাসে তেল ও গ্যাস শিল্প থেকে গড়ে মাসিক ১.২ ট্রিলিয়ন রুবল রাজস্ব আয় করেছে রাশিয়া। এই অর্থ ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের গড় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই পরিমাণ আয় রাশিয়া এমন সময় করেছে যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের উচ্চমূল্য নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ চরমে ছিল।
রাশিয়া ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা রোধের পশ্চিমাদের ব্যর্থতা যেন দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলোর ব্যর্থতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ইউক্রেন আক্রমণের আগে রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করত ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর পরই আমদানিকারকের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করলে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল বা পরিশোধিত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ।
এমনকি রাশিয়ার তেলের ওপর মূল্যসীমাও নির্ধারণ করে দেয় জি-৭ জোটের দেশগুলো। যার লক্ষ্য ছিল সব পশ্চিমা শিপিং সংস্থা ও বিমা কোম্পানিগুলোকে প্রতি ব্যারেল তেলের জন্য ৬০ ডলারের বেশি মূল্যে রাশিয়াকে তেল রপ্তানিতে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখা। তবে পশ্চিমাদের এই প্রচেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইউক্রেনে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। একই সঙ্গে অব্যাহত রেখেছে মূল্যসীমা আরোপের আগে দেশটির রপ্তানি করা তেলের পরিমাণ।
নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে না পারলেও মূল্যসীমা আরোপের সিদ্ধান্তটি একটি সাফল্য হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, রাশিয়া বেশিরভাগই বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে তেল রপ্তানি করে থাকে। মূল্য নির্ধারণ করার পর এই প্রক্রিয়ায় তেল রপ্তানিতে বাধার সম্মুখীন হয় রাশিয়া।
এতে দেশটির উপভোগ করা সম্ভাব্য রাজস্বের পরিমাণও কিছুটা কমে আসে। তবে পশ্চিমাদের এমন সিদ্ধান্তকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় নেয়নি রাশিয়া। জানা গেছে, এর প্রতিক্রিয়ায় তেলবাহী জাহাজগুলোর তথাকথিত ডার্ক ফ্লিট বা অন্ধকার বহর তৈরি করেছে রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার তেলের শীর্ষ তিনটি রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় রয়েছে চীন, ভারত ও তুরস্ক। আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে এখন তেল আমদানির দিকে ঝুঁকেছে যুক্তরাজ্য।
গাল্ফ অঞ্চল থেকে আগের তুলনায় অনেক বেশি তেল এবং তেলপণ্য আমদানি করছে দেশটি। সুলভ মূল্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়া থেকে রেকর্ড পরিমাণ তেল আমদানি করছে ভারতীয় তেল শোধনাগারগুলো। সেখান থেকে রেকর্ড পরিমাণ পরিশোধিত তেল আমদানির সুযোগ লুফে নিচ্ছে যুক্তরাজ্যও। ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারত থেকে দেশটির আমদানি করা তেলের পরিমাণ বেড়ে ১৭৬ শতাংশ হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের গাড়ি এবং ব্রিটিশ বিমানবন্দরগুলোতে বিমানে এখনো সীমিত পরিমাণে রাশিয়ার তেল ব্যবহার করা হয়। তবে এর পরিমাণ সঠিকভাবে জানা অবশ্য কঠিন।