ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আজকের রূপ লাভ করেছে। প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের ভিত্তিকে আমলে না নিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থানকে তোয়াক্কা না করে ক্রমাগত ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারণার টার্গেট হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, ভোট-রাজনীতি এবং মিডিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ভারতের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের পেছনের কারণ, এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে এর জটিলতা বিশ্লেষণ করা যাক-
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং ভোট-রাজনীতি
ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কেন্দ্রগুলো, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিক অপকৌশল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের একটি প্রধান কারণ।
বিজেপি দলের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু-বিরোধী নীতির মধ্য দিয়ে এই অপপ্রচার আরও তীব্র হয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, এবং ত্রিপুরা- যেখানে বাঙালি ও মুসলিম জনগণের বসবাস রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ও মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব জোরদার করার জন্যই এই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেয়ার জন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে বাঙালি এবং মুসলিম-বিরোধী মনোভাব তৈরি করতে বিভিন্ন অপপ্রচার চালায়। এসব প্রচারণা দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় নাগরিকদেরকে ‘অবৈধ’ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদেরকে ‘ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধি’ বা ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে তুলে ধরে। এই ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে বিজেপি স্থানীয় হিন্দু ও অবাঙালি ভোটারদের মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনা তৈরি করে, যা তাদেরকে ভোটের মাঠে সহযোগিতা করে।
এছাড়াও আসাম ও ত্রিপুরা প্রদেশে বাঙালি ও মুসলিমদের নিয়ে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন ভুয়া খবর এবং অতিরঞ্জিত ঘটনা প্রচার করা হয়। আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকা (NRC) কার্যক্রম এই অপপ্রচারের অপব্যবহারের অন্যতম উদাহরণ। সেখানে বাঙালি ও মুসলিমদের ‘অবৈধ’ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা পরবর্তীতে সরাসরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এসব অপপ্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় হিন্দু ভোটারদের মধ্যে মুসলিম বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করা হয়, যা বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলকে মজবুত করে।
মিডিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থ
ভারতীয় মিডিয়ার কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো একটি বাণিজ্যিক সুযোগও। সংবাদমাধ্যমের ব্যবসা মূলত কাটতি বাড়ানোর উপর নির্ভর করে। ফলে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর অতিরঞ্জিত বা নেতিবাচক উপস্থাপন এই ধরনের ক্লিক-বেইট মিডিয়া ব্যবসার জন্য আদর্শ পণ্য।
বিশেষত, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের আবেগের সঙ্গে খেলা করে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করাও ভারতীয় মিডিয়ার উদ্দেশ্য হতে পারে। বিশেষত টেলিভিশন ও প্রিন্ট পত্রিকাসমূহে বাংলাদেশ নিয়ে অতিরঞ্জিত বা নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদন বাংলাদেশকে ভারতের কৌশলগত স্বার্থবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঘটনাটি ভারতীয় মিডিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘদিন ধরে ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য নতজানু অবস্থানে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবন্টনের অমীমাংসিত চুক্তি, সীমান্ত হত্যা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীতে গণবিক্ষোভে রূপ নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হওয়া ভারতীয় মিডিয়ার জন্য আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিন্যাস হওয়ার সম্ভাবনা এবং ভারতের প্রভাব হ্রাস পেতে পারে- এমন আশঙ্কা ভারতীয় মিডিয়াকে আরও আক্রমণাত্মক করে তুলেছে।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থনও এই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেড় দশকেরও বেশি সময় শেখ হাসিনার সরকার ইসলামপন্থী দলগুলোকে কোণঠাসা করে রাখলেও, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনে তারা ড. ইউনুসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ও ক্ষমতার ভারকেন্দ্রে অবস্থান করছে। ভারতীয় মিডিয়া এই দলগুলোর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
ভারতবিরোধী মনোভাব এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা
ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান, বিশেষ করে নতুন সরকারের প্রতি ইসলামী দলগুলোর সমর্থন পাওয়া ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোকে ‘চরমপন্থী’ হিসেবে চিত্রিত করতে চায় এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে চায়।
বিশেষ করে ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলার ঘটনা তুলে ধরে বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতা ও ধর্মীয় সহিংসতার প্রতি স্থানীয় নাগরিকদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলে। এসব খবর অত্যন্ত অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা ভারতের হিন্দু জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে।
ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ভারতের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ধর্মীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়। অথচ, এটি কেবল দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং দুই দেশের জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।
এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং মিডিয়া স্তরে শক্ত অবস্থান নেয়া অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে সরকার এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচারের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারতীয় অপপ্রচারের মোকাবিলা করা সম্ভব।
ভারতের সচেতন নাগরিকদেরও এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যপকভাবে সোচ্চার হওয়া উচিত। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই দুইদেশের গণমাধ্যমের আরও বেশি বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত।
এম.কে.