
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার দাবি করে এসেছেন, তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প খাত ফিরছে। তিনি প্রশংসা করেছেন সেই সব কোম্পানির, যারা যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার চিপ থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত তৈরি করতে বড় অংকের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
তবে ঘোষণার চেয়ে বাস্তবতা অনেক কঠিন। দীর্ঘমেয়াদে কেন কোনো কোম্পানি কিংবা রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করবে—যে দেশটি মাত্র কয়েক সপ্তাহেই বিশ্ব অর্থনীতির চেনা ছক এলোমেলো করে দিয়েছে? ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র এক স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ ও বিশ্ব নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যে নির্ভরযোগ্য অংশীদার থেকে অচিরেই হয়ে ওঠে অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের উৎস।
এই পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন জার্মানির এক সংবাদমাধ্যমকে সোজাসাপ্টা বলেন, “পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ছিল, সেটা আর নেই।”
অর্থাৎ, বাণিজ্যের দুনিয়ায় এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রই আর একচ্ছত্র খেলোয়াড় নয়।
নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, যার মোট জিডিপি প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে বিশ্বব্যাংকের মতে, দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের জিডিপি প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১৭ ট্রিলিয়ন ইউরো বা ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা সিএনএন-কে বলেন, “আমাদের সংগঠনের ১৬৬টি সদস্য দেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিশ্ব বাণিজ্যের মাত্র ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৮৭ শতাংশ বাণিজ্য হচ্ছে অন্যদের মধ্যে।”
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বছরের পর বছর “শোষণ” করে আসছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার অনেক দেশের জন্য ঈর্ষণীয় ছিল। বর্তমানে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন ২৫% শুল্ক অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের ওপর, মেক্সিকো ও কানাডার ক্ষেত্রে কিছু পণ্যে যেসব ফ্রি-ট্রেড চুক্তির আওতায় নয়, তাদের ওপরও ২৫% শুল্ক; চীনা পণ্যে আরোপ করা হয়েছে ১৪৫% পর্যন্ত শুল্ক; গাড়িতে ২৫% এবং অটো পার্টসে বাড়তি শুল্ক আসছে শিগগিরই; সর্বোপরি সব আমদানির ওপর রয়েছে ১০% বেসলাইন শুল্ক।
তবে এই সংখ্যাগুলো ট্রাম্পের শুল্কনীতির রোলারকোস্টার গতিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে না। কখনো শুল্ক আরোপ, আবার সেগুলো প্রত্যাহার, পরে আবার নতুন করে ঘোষণা—এই নীতির অস্থিরতা ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
সম্প্রতি মুডিস রেটিংস জানিয়েছে, “এই শুল্কনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে স্পষ্টভাবেই মন্থর করবে। আর নীতিনির্ধারণে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ বিশ্বব্যাপী আস্থায় ধাক্কা দিয়েছে।”
ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল এক অনুষ্ঠানে বলেন, “এটি অত্যন্ত মৌলিক নীতিগত পরিবর্তন। আধুনিক কালে এমন অভিজ্ঞতা নেই, কীভাবে এসব চিন্তা করতে হবে।” তার এই মন্তব্যে মার্কিন শেয়ারবাজারে পতন হয়। আরেকদিকে, ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়েলকে আক্রমণ করে বলেন, “পাওয়েলকে বরখাস্ত করতে দেরি করা যাবে না!”
এরই মধ্যে চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া থেকে শুরু করে রপ্তানিনির্ভর কোম্পানি বোয়িং এবং সাধারণ ভোক্তারাও ক্ষতির মুখোমুখি—বিশেষ করে যাঁরা সস্তায় পোশাক ও প্রসাধনী কেনেন টেমু বা শেইনের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে।
চীন ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শুল্কযুদ্ধের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা কমিয়ে নতুন বাণিজ্যিক অংশীদার খুঁজতে শুরু করে। চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপপরিচালক শেং লাইইউন জানান, ২০১৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির ১৯.২% যেত যুক্তরাষ্ট্রে, যা ২০২৪ সালে কমে ১৪.৭%-এ নেমে এসেছে। চীন এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য জোরদার করতে চায়।
বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, চীনের ইউরোপ বা মিত্রদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। “না, কেউ আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না,” বলেন তিনি।
তবে কেবল চীন নয়, কানাডাও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক কানাডীয় নাগরিক ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি লিখেছেন, “কানাডা ও ইউরোপ একসঙ্গে কাজ করে আমাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে। এই অস্থির সময়ে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছি।”
ভন ডার লেইয়েন বলেন, কেবল ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতেই সবাই আগ্রহী নয়, বরং সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও পূর্বানুমানযোগ্যতার জন্যও ইউরোপ এখন মূল্যবান হয়ে উঠছে।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দ বলেন, “এটি এমন এক মুহূর্ত যখন আমাদের নিজস্ব ভাগ্য নিজেরা নির্ধারণের সময় এসেছে। এটি আমাদের স্বাধীনতার পথে যাত্রা।”
শহীদ