
ছবিঃ সংগৃহীত
সময়টা এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ার। এই দুনিয়া যেমন বিশ্বকে ছোট করে এনেছে, তেমনি ফেলেছে মারাত্মক হুমকিতে। মানুষ আজ ভার্চুয়াল জগতে ২৪ ঘণ্টা বুঁদ হয়ে আছে, কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সামান্য ফুরসত পেলেই ঢুকে পড়ছে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে। কিন্তু কজন জানেন—এই আসক্তি মহামারির চেয়েও ভয়াবহ? এই আসক্তি ধ্বংস করছে জীবন, পরিবার, এমনকি পুরো জাতিকে।
আপনারা কি ভুলে গেছেন ঐশীর কথা? মোবাইল আসক্তির কারণে মাদকে জড়িয়ে একাই হত্যা করেছিলেন নিজের জন্মদাতা পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মাকে। গেল ২২ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ছেলের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়ায় নামাজরত পিতাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে রিফাত। এসব ঘটনা নিছক বিচ্ছিন্ন নয়—এগুলো ডিজিটাল আসক্তির ভয়ঙ্কর পরিণতি।
স্ক্রল করতে করতে সময় কতটা পেরিয়ে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। একটা সিরিজ (series) দেখতে দেখতে কখন যে রাত তিনটা-চারটা বেজে যায়, বলা মুশকিল। এতে ঘুমের ব্যাঘাত তো হবেই, সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় দিন-রাতের পার্থক্য। তরুণরা রাতভর স্ক্রিনে ডুবে থাকে, ফলে লেখাপড়া ভুলে যায়, এমনকি খাওয়া-দাওয়াও উপেক্ষিত হয়।
গেমস, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় মগ্ন এই প্রজন্মের এক বড় অংশ দিনের আলো না দেখেই কাটিয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে—দেশের ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট আসক্তির কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ২৬.১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, তাদের মানসিক সমস্যার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী ইন্টারনেট। ৫৯.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটকে আংশিকভাবে দায়ী করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই অনিদ্রা, বিষণ্নতা, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা।
অ্যাডভেঞ্চার ও সহিংস কনটেন্ট দেখে কেউ বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ যৌন হয়রানিমূলক ভিডিও দেখে জড়িয়ে পড়ছে ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে। আবার কেউ ‘ফাইটিং গেম’ বা মারামারিভিত্তিক ভিডিও দেখে চুরি, ডাকাতির পরিকল্পনায় লিপ্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে শরীরের হরমোনাল ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে দেখা দেয় ক্লান্তি, হতাশা, ওজন বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগ।
আমাদের শরীর গঠিত হয়েছে দিনে কাজ করার এবং রাতে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু রাত জেগে মোবাইলে বা ল্যাপটপে সময় কাটানোর ফলে শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ ও হরমোনাল সাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। এতে মানসিক ও শারীরিকভাবে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে মানুষ।
ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি যেন এক নীরব বিষ। যা শরীর, মন, সমাজ—সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলছে ধীরে ধীরে। এই আসক্তি যতটা না মানব কল্যাণে কাজে লাগছে, তার চেয়ে ঢের বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধ, অসুস্থতা আর মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি।
ইমরান