ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

ঘুমের সমস্যা? ডা. তাসনিম জারার পরামর্শে সহজ ঘরোয়া সমাধান

প্রকাশিত: ১০:১৪, ১৯ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১০:১৫, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

ঘুমের সমস্যা? ডা. তাসনিম জারার পরামর্শে সহজ ঘরোয়া সমাধান

ছবি: সংগৃহীত

একসময়ের স্বাস্থ্যবিষয়ক জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর ডা. তাসনিম জারা। তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের একজন চিকিৎসক ও ‘সহায় হেলথ’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব।

২০২০ সালে ‘সহায় হেলথ’ এর ফেসবুক পেজ থেকে আপলোড করা এক স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক ভিডিওতে ডা. তাসনিম ঘুমের সমস্যার প্রতিকার হিসেবে কিছু কার্যকর ঘরোয়া উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। ‘ঘুমের সমস্যার ঘরোয়া চিকিৎসা’ শিরোনামের সেই ভিডিওতে তিনি যা যা বলেছেন নিচে তা তুলে ধরা হলো-

রাতে ভালো ঘুম হয় না, ঘুম আসতে দেরি হয়, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি এর-- সমাধান কি? আমরা অনেকেই নিদ্রাহীনতায় ভুগী। এর ফলে দিনের বেলায় হাই তুলতে থাকি, কাজে মনোযোগ দিতে কষ্ট হয়, সারাদিন মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।

আমি এই ভিডিওতে নিদ্রাহীনতার চিকিৎসা নিয়ে কথা বলবো। উল্লেখ করবো ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন কারণ ও তার চিকিৎসা। এগুলোর কোনটাই আমার মনগড়া কথা না, সবগুলোই গবেষণা থেকে তুলে ধরা। কোন চিকিৎসাটা আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, সেটা শেষে বলবো, তাতে বুঝতে সুবিধা হবে।

১। দিনের বেলায় ‘দুশ্চিন্তার সময়’ রাখুন

গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমাতে গেলে অনেকের নানা দুশ্চিন্তা মাথায় আসতে থাকে। ফলে ঘুম আসে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটা পদ্ধতি আছে। যাকে বলে ‘Worry Time’। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় ‘দুশ্চিন্তার সময়’। অর্থাৎ দুশ্চিন্তাগুলো নিয়ে ভাবার জন্য দিনের বেলাতেই একটা আলাদা সময় রাখা।

ধরুন, আপনি ঠিক করলেন প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা আপনার দুশ্চিন্তার সময়। এই সময় আপনি আপনার দুশ্চিন্তাগুলো নিয়ে ভাববেন। তাহলে এগুলোর দিনেই সমাধান হয়ে গেল, ঘুমাতে গেলে আর আপনাকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু ঘুমানোর সময়ে যদি আবার নতুন দুশ্চিন্তা আসে, নিজেকে বলবেন, এটা আগামীকালের জন্য। এখন এটা নিয়ে ভাববার প্রয়োজন নেই।

২। কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে

চা, কফি, কোমল পানীয়, আর এনার্জি ড্রিংকস। কারণ এগুলোতে আছে ক্যাফেইন। ক্যাফেইন ঘুম আসতে দেয় না, ঘুম আসলেও গভীর হতে দেয় না। তাই ঘুমের সমস্যা থাকলে এগুলো না খাওয়াই ভালো। বিশেষ করে ঘুমের ছয় ঘণ্টা আগে এগুলো খাওয়া যাবে না।

৩। ঘুমের কাছাকাছি সময় গরম দুধ পান

গবেষণায় দেখা গেছে, দুধে এমন উপাদান আছে, যা ভালো এবং লম্বা সময় ধরে ঘুম হতে সাহায্য করে।

৪। ‘Wine down time’ পদ্ধতি

নিদ্রাহীনতা রোগীদের চিকিৎসায় আরেকটা পদ্ধতি শেখানো হয়, তা হলো ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক ঘণ্টার রিল্যাক্স করা। এটাকে বলে ‘Wine down time’। দিনের ব্যস্ততা আর দুশ্চিন্তাগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে এই সময়টা ব্যবহার করতে বলা হয়। এই এক ঘণ্টায় যেসব কাজের পরামর্শ দেওয়া হয়, সেগুলো হলো বই পড়া, ডায়েরি লেখা, গরম পানি দিয়ে গোসল করা, মনে প্রশান্তি আনে এমন শ্রুতিমধুর কিছু শোনা, যেমন- ধর্মগ্রন্থ বা কবিতা আবৃত্তি, গান, যেটা আপনার জন্য কার্যকর হয়।

যেসব কাজ করতে মানা করা হয়, সেগুলো হলো ঘুমানোর আগে টিভি দেখা, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করা। কারণ এই যন্ত্রগুলোর স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলো মস্তিষ্ককে সজাগ করে তোলে। ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়।

৫। ‘Stimulus control’ পদ্ধতি

যাদের বিছানায় শুয়ে থাকার পরও ঘুম না আসার সমস্যা আছে তাদের জন্য ‘স্টিমুলাস কন্ট্রোল’ নামক চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো আপনার মস্তিষ্ক যাতে শোবার ঘর এবং বিছানা দেখলে ঘুমের কথা চিন্তা করে। শোবার ঘরের সাথে সাথে অনিদ্রার কথা মাথায় না আসে।

এই চিকিৎসার বেশ কয়েকটা নির্দেশনা আছে। তার মধ্যে একটা হলো ঘুম না আসলে জোর করে বিছানায় শুয়ে না থাকা। যদি ১০ থেকে ২০ মিনিট সময় ধরে শুয়ে থেকে ঘুম না আসে, তাহলে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে যাবেন। এমন কিছু কাজ করবেন যতক্ষণ ঘুম না আসে। তারপর ঘুম আসলেই কেবল বিছানায় ফেরত যাবেন। পাশের রুমে কী কী করতে পারেন। হালকা আলোয় বই পড়তে পারেন, গান শুনতে পারেন। তবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না। কারণ ফোনের উজ্জ্বল আলো ঘুম আসতে বাধা দিতে পারে।

৬। শুধু ঘুমের জন্য বিছানা ব্যবহার

‘স্টিমুলাস কন্ট্রোল’ চিকিৎসার পরামর্শের আরেকটি নির্দেশনা হলো বিছানা শুধু ঘুমের জন্য ব্যবহার করা, বিছানায় অন্য কাজ না করা। আমরা অনেকেই বিছানায় খাবার খাই, পড়াশোনা করি, মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করি। বাসায় থাকলে দিনের অনেকটা সময় বিছানায় কাটাই। ঘুমের সমস্যা কমাতে চাইলে এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

৭। বারবার সময় না দেখা

অনেক নিদ্রাহীনতার রোগী বারবার ঘড়িতে সময় দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এটা তাদের ঘুমের ওপর খারাপ একটা প্রভাব ফেলে। তাই তাদেরকে ঘড়ির দিকে না তাকানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কী কী উপায়ে এটা করা যেতে পারে? ঘড়ির মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে রাখা, দেওয়ালে ঘড়ি থাকলে সেটা নামিয়ে নেওয়া, আর ফোনটা দূরে রেখে ঘুমানো।

৮। ‘ভালো ঘুম’ নিয়ে চিন্তা না করা

গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকের মনে ঘুম নিয়ে এমন কিছু ধারণা থাকে, যা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে এবং ভালো ঘুম হতে ব্যাঘাত ঘটায়। অনেকে ভাবেন, প্রতিদিন আমাকে আট ঘণ্টা ঘুমাতেই হবে। যখন আট ঘন্টা ঘুমানো আপনার জন্য সম্ভব নয়, আবার ঘুমাতে গেছেন, ঘুম আসছে না, এরমধ্যে দুশ্চিন্তা শুরু করলেন, আজ রাতে ভালো ঘুম না হলে কালকে কাজে খারাপ করবো বা পরীক্ষায় ফেল করবো। আবার মাঝরাতে চিন্তা শুরু করলেন যে, নিদ্রাহীনতা কোনোদিনও সারে না, আমার এটা সারাজীবন থাকবে। আপনার মাথায় যদি এমন চিন্তা আসে, তাহলে সেটাকে ধরে ফেলবেন আর ঠাণ্ডা মাথায় নিজেকে বোঝাবেন, এই চিন্তাগুলোর কোনো ভিত্তি আছে কিনা।

৯। ঘুমানোর ঠিক আগে ভারি কিছু না খাওয়া

ঘুমানোর আগে আগে অনেক বেশি করে খাবার খেলে কারো কারো ঘুম ভালো নাও হতে পারে। যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা আছে, তাদের জন্য ঘুমানোর তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে রাতের খাবার সেরে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

১০। ধূমপান এড়িয়ে চলা

ধূমপান এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ নিকোটিন একটি উত্তেজক পদার্থ। যারা ধূমপান করেন তারা সহজে ঘুমাতে পারেন না। ঘন ঘন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেন এবং প্রায়ই তাদের ঘুম ব্যাহত হয়। একদম সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা সম্ভব না হলে অন্তত ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে ধূমপান থেকে বিরত থাকবেন।

১১। নিয়মিত ব্যায়াম করা

একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো নিয়মিত ব্যায়াম করা। শরীর সচল রাখলে রাতে ঘুম ভালো হয়। তবে ঘুমানোর তিন ঘণ্টা আগে ব্যায়াম পরিহার করতে হবে।

১২। ঘুমের রুটিন তৈরি করা

শরীরকে প্রতিদিন একই সময় ঘুমাতে অভ্যস্ত করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো আর ঘুম থেকে জেগে ওঠা প্রয়োজন। যেমন, আপনি যদি ঠিক করেন যে, প্রতিদিন রাত ১১টায় ঘুমাতে যাবেন আর সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠবেন। তাহলে এই যে রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত সময় আপনার শরীর একটা ভালো ঘুম দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। জেগে ওঠার সময়টা প্রতিদিন একই রাখার চেষ্টা করবেন। শুক্রবারে বা ছুটির দিনে আমরা একটু দেরি করে উঠতে পছন্দ করি। এটা পরিহার করতে হবে।

১৩। দিনের বেলা না ঘুমানোর চেষ্টা

নিদ্রাহীনতার চিকিৎসায় দিনের বেলায় ঘুমাতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আর দিনের বেলা যদি ঘুমাতেই হয়, তাহলে দুপুরে আগে আগে ঘুমিয়ে নিবেন, তাও ৪০ মিনিটের বেশি নয়।

এখন বলছি কোন সমাধানটা আপনার জন্য প্রযোজ্য। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নিদ্রাহীনতা অন্যান্য রোগ থেকে একটু ভিন্ন। যেমন- টাইফয়েড বা করোনা ভাইরাস হলে আমরা নিশ্চিত জানি যে, আপনার শরীরে একটা জীবাণু প্রবেশ করেছে। নিদ্রাহীনতার ক্ষেত্রে তেমন নিশ্চিত একটা কারণ নাও থাকতে পারে। একেকজনের জন্য একেকটা হতে পারে।

আমি যে ১৩টি কারণ ও তার চিকিৎসা বলেছি, তার সবগুলো আপনার জন্য প্রযোজ্য হবে না। যেটা যেটা আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, শুধু সেটাই আপনি পালন করবেন। যদি এসব ব্যবস্থা নিয়েও ঘুমের সমস্যার সমাধান না হয়, ঘুমের অভাব নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, আপনার দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়, ঘুম নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা হতে থাকে, তবে ডাক্তারের সহায়তা নিবেন, নিজে নিজেই ঘুমের ওষুধ খাবেন না।

সূত্র: https://www.facebook.com/watch/?v=355301162176298&rdid=CyRPUAj2PHLQm5x8

রাকিব

×