
সংগৃহীত
পান্তা ভাত,বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ। গ্রামবাংলার কৃষকের পরিশ্রমের সঙ্গী এই খাবারটি আজ শুধু উৎসবেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতার কারণেই তা হয়ে উঠছে স্বাস্থ্যসচেতন অনেক মানুষের নিত্য খাদ্য।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে শারীরিক পরিশ্রম করার জন্য শক্তি জোগাতে কৃষকেরা যেভাবে পান্তা ভাত খেয়ে থাকেন, তা অনেকের কাছেই জানা। অন্যদিকে শহরাঞ্চলেও পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ এখন এক অবিচ্ছেদ্য উৎসব-সংস্কৃতি। তবে এই পানিতে ভেজানো ভাত যে শুধু ঐতিহ্যের প্রতীক নয়, বরং স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও অত্যন্ত উপকারী,তা এখন গবেষণায়ও প্রমাণিত।
কীভাবে তৈরি হয় পান্তা ভাত?
রাতের অতিরিক্ত রান্না করা ভাত রেখে পরিমাণমতো পানি ঢেলে ঢেকে রাখা হয় একটি পাত্রে। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর সেই ভাতই হয়ে ওঠে পান্তা ভাত। সকালে সাধারণত লবণ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, লেবু বা সরিষার তেল দিয়ে খাওয়া হয়। উৎসবের দিনে এর সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা যোগ হয়ে তা হয়ে ওঠে বিশেষ খাবার।
পুষ্টিগুণে ভরপুর পান্তা ভাত
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পান্তা ভাতে সাধারণ সেদ্ধ ভাতের তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টি উপাদান থাকে। এতে রয়েছে লোহা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিঙ্ক, ফসফরাস ও ভিটামিন বি। উদাহরণস্বরূপ, ১০০ গ্রাম সাদা ভাতে যেখানে লোহা থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম, সেখানে একই পরিমাণ পান্তা ভাতে থাকে প্রায় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম লোহা। একইভাবে ক্যালসিয়ামও চারগুণ বেশি পাওয়া যায়।
এই ভাতে ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়াও তৈরি হয়, যা আমাদের হজম শক্তি উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এই উপকারী ব্যাকটেরিয়া দইতেও পাওয়া যায়।
পান্তা ভাতের স্বাস্থ্য উপকারিতা
পান্তা ভাত সহজে হজম হয়। গ্যাস, বদহজম বা আলসারের সমস্যা যাঁদের রয়েছে, তাঁদের জন্য এটি উপকারী।
শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
লোহার আধিক্য রক্তস্বল্পতা দূর করে ও শরীরে রক্ত বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে, যা হাড়ের ক্ষয় বা দুর্বলতার বিরুদ্ধে কাজ করে।
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগীদের জন্য উপকারী।
গরমকালে শরীর ঠান্ডা রাখে ও পানিশূন্যতা দূর করে।
গবেষণায় প্রমাণিত, পান্তা ভাতে এমন কিছু উপাদান (যেমন: বিটা-সিটোস্টেরল, ক্যাম্পেসটেরল) রয়েছে, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে ও কোলেস্টেরল হ্রাস করে।
কিছু ফ্ল্যাভোনয়েড উপাদান (যেমন: আইসোরামনেটিন সেভেন গ্লুকোসাইড) ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।
কারা খেতে পারেন, কারা এড়িয়ে চলবেন?
পান্তা ভাত যাঁরা রোদে বা বাইরে দীর্ঘ সময় কাজ করেন, তাঁদের শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এবং ডিহাইড্রেশন রোধে সহায়তা করে। পেটে সমস্যা, অম্লতা, রক্তশূন্যতা কিংবা হাড়ের দুর্বলতা থাকলে এটি অত্যন্ত উপকারী।
তবে যাঁরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের জন্য নিয়মিত পান্তা খাওয়া উপযুক্ত নাও হতে পারে, কারণ এতে ক্যালরি তুলনামূলক বেশি। আবার পরিষ্কার পানিতে না ভিজিয়ে বা অপরিষ্কার পাত্রে পান্তা তৈরি করলে বিপদ হতে পারে,জীবাণু জন্ম নিয়ে পেটের সমস্যা, এমনকি ফুড পয়জনিং-ও হতে পারে।
সতর্কতা
পান্তা ভাত দীর্ঘ সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখলে স্বল্পমাত্রার এলকোহল তৈরি হতে পারে, যা খেলে ঘুমঘুম ভাব আসতে পারে। তাই যাঁরা দিনভর কাজে মনোযোগ রাখতে চান, তাঁদের জন্য সকালের খাবার হিসেবে এটি উপযুক্ত কি না, তা ভেবে খাওয়া উচিত।
পান্তা ভাত বাংলাদেশের সংস্কৃতিরই একটি অংশ, তবে এর গুরুত্ব এখন শুধুমাত্র ঐতিহ্যে নয়, বরং পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতার দিক থেকেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এটি সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং ঘরোয়া খাদ্য,যা প্রতিদিনের খাবারে মাঝেমধ্যে যুক্ত করা গেলে শরীরের জন্য ভালো। তবে স্বাস্থ্যগত অবস্থান বুঝে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে এটি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম।
সূত্র:https://tinyurl.com/hzey35h2
আফরোজা