
ছবিঃ সংগৃহীত
ধীরে ধীরে বাড়ছে গরমের তাপমাত্রা, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ব্যস্ত নগরী। গত কয়েকদিনের তাপমাত্রা, নগরের ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম সবমিলিয়ে বেশ অতিষ্ঠ করে তুলছে রাজধানীর জনজীবন। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। আর এ গরমে ক্ষণিকের তৃপ্তি মেটাতে সস্তা আখ-লেবুর শরবতে ঝুঁকছেন রাজধানীবাসী। তবে, রাস্তার ধারের এসব ঠান্ডা আখ-লেবুর শরবত শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই অনিরাপদ পানি বা বরফ দিয়ে বানানো শরবতগুলো খাওয়ার ফলে পানিবাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড,জন্ডিস, হেপাটাইটিসের মতো রোগগুলো ছড়াতে থাকে। এছাড়া ফুড পয়জনিং, বমিও হতে পারে। গরমের সময় ঢাকায় কিন্তু এই অসুখগুলো বেড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাজধানীর নিউমার্কেট, টিএসসি, নীলক্ষেত, বাংলামোটরসহ আশেপাশের এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন রং-বেরঙের ও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের শরবত বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই পান করছে রাস্তার পাশের শরবত।
এসব দোকানে লেবুর শরবত প্রতি গ্লাস ১০ টাকা, প্যাকেটজাত ফ্লেভার দিয়ে বানানো ৫০০ মিলি লিটার বোতলের শরবত ২০ টাকা, আখের শরবত ২০ টাকা, বেলের শরবত প্রতি গ্লাস ২০ টাকা ও তোকমাসহ হরেক-রকমের ফল দিয়ে বানানো শরবত প্রতি গ্লাস ২৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
এসব শরবতের ঠান্ডা বরফ কোথা থেকে আসে প্রশ্ন করলে নিউমার্কেটের শরবত ব্যবসায়ী মতিন বলেন, এই বরফ সাধারণত মাছের জন্য নিয়ে আসা হয় সেখান থেকে আমরা নিই। এক বস্তা নিলে সারাদিনের ব্যবসা হয়ে যায়। এসব বরফ মেশানো শরবত খাওয়া ঠিক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামা ভাল-খারাপ এত বুঝি না। আমার পেট চললেই হইবো।
কলেজে ক্লাস শেষ করেই শরবতের দোকানে এক গ্লাস শরবত চাইতে দেখা গেল এক শিক্ষার্থীকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে জানি যে এই শরবত খাওয়া ঠিক না, তবে অনেক গরম পড়ছে এজন্য ক্লাস শেষ করেই ভাবলাম ঠান্ডা শরবত খাই, কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যাবে।
সামনে যেতেই দুই সন্তানকে নিয়ে আখের জুস খেতে দেখা যায় একজন মাকে। জানতে চাইলে তিনি জানান, মেয়েদের স্কুল-কলেজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ, মেয়েরা গরমে আখের ঠান্ডা জুস খেতে চাইলো, এক পর্যায়ে সবাই মিলে খাচ্ছি। তবে, এগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর, খাওয়া ঠিক না বলেও জানান তিনি।
রাস্তার পাশে রিকশা থামিয়ে শরবত পান করছিলেন সিদ্দিক মিয়া। তিনি বলেন, সারাদিন রোদের মধ্যে ঘুরতে হয়। কত আর সহ্য করা যায়। তাই কোথাও থামলে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাই, এটা খেলে কিছুটা শান্তি পাই। এই লেবুর শরবত পরিষ্কার পানিতে বানানো হচ্ছে কিনা যাচাই করেছেন কখনও—এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, এগুলো তো পরিষ্কার পানি দিয়েই বানায় না হলে মানুষ এতো খাবে কেন?
শরবত বিক্রেতা পান্নার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শরবত বানাই ফিল্টারের পানি দিয়ে। সব পানিই পরিষ্কার। আর ফিল্টার পানি আমাকে দিয়ে যায় যারা পানি (বড় জার) বিক্রি করে। আমার শরবত একবার যে খায় তার মুখে লেগে যায়, বার বার আসে, চাইলে আপনি এক গ্লাস খেতে পারেন, ভাল লাগবে।
এই গরমে ফুটপাতের ধারে বসা নানান রকমের ঠান্ডা শরবত খাওয়া কতটা যৌক্তিক? জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, গরমের সময়ে প্রয়োজনীয় পানি খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য জরুরি। কিন্তু রাস্তার ধারে ফুটপাতের খোলা অবস্থায় যেসব পানীয় বিক্রি হচ্ছে, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কারণ যে পানি রাস্তার পাশে বিক্রি হয়, সেখানে দেখা যাচ্ছে পানির পাত্রটি ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। গ্লাসগুলো ঠিকমতো ধোঁয়া হচ্ছে না। ফলে জীবাণু থেকে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, একই গ্লাস বারবার ব্যবহারের ফলে একজনের জীবাণু আরেকজনের মধ্যেও যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, একজন সুস্থ মানুষের শরীরে সহজেই সংক্রমিত হচ্ছে। রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর পানীয় পান করায় পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও দূষিত পানির কারণে অন্যান্য রোগ বাড়ছে। বিশুদ্ধ ও ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, মনে করুন ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয় পান করলেন। কিছুদিন পর হঠাৎ খেয়াল করলেন, আপনার চোখ কিংবা প্রস্রাব হলুদ বর্ণের হয়ে গেল। সঙ্গে তীব্র বমি ও পেটে ব্যথা! আসলে এসব পানীয়র মাধ্যমে এক্যুইট হেপাটাইটিসের জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ করেছে। যার ফলে ডায়রিয়া কিংবা রক্ত আমাশয় হতে পারে আবার কিডনিও বিকল হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়াবে এ ধরনের শরবত বা পানীয়। তাই এসব শরবত ও পানীয় এড়িয়ে চলা ভালো।
ইমরান