ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

ভাঙছে স্বাস্থ্য খাতের সিন্ডিকেট, বন্ধ বদলি বাণিজ্য

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৪ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ২৩:৪২, ২৪ মার্চ ২০২৫

ভাঙছে স্বাস্থ্য খাতের সিন্ডিকেট, বন্ধ বদলি বাণিজ্য

সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল স্বাস্থ্য খাত

একটা সময় সুনির্দিষ্ট একটা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল স্বাস্থ্য খাত। মন্ত্রণালয়ের সামান্য কর্মচারী আবজাল-মিঠুও নানা রকম তদবির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছিল কোটি কোটি টাকা। হাসপাতালের জন্য কি যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে, মেডিকেল ভর্তির বিষয়াদি, বিভিন্ন পদে নিয়োগ-বদলি, বিদেশে প্রশিক্ষণসহ সব কিছুই এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করত।

গুটিকয়েক চিকিৎসকের হাতেই ছিল যেন সব নিয়ন্ত্রণ। তাদের সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাও। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে এই সরকারের আমলে বদলি বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে পুরোপুরিভাবে। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের সংযুক্তি (অ্যাটাচমেন্ট)। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই খাতে এসেছে স্থিতিশীলতা। 


আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৈরি হয় অস্থিরতা। কয়েকদিনের ব্যবধানে মহাপরিচালক বদল হয় দু’বার। মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও কর্মস্থলে যোগদান করতে পারেননি অধ্যাপক ডা. রোবেদন আমিন। বাধ্য হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরকে। কিন্তু তার পরও নানা বিষয়ে চলতে থাকে বিপত্তি।

নিয়োগ পাওয়া পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আবু হানিফসহ অন্যদের যোগদানকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি হামলা পর্যন্ত হয় বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ও জামায়াতপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ) নেতাদের মধ্যে।  


এমন পরিস্থিতিতে অধিদপ্তরের হাল ধরেন অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানের নির্দেশনায় অধিদপ্তরে সব ধরনের নিয়োগ বাণিজ্য শক্ত হাতে দমন করেন তিনি। 


অভিযোগ ছিল, দীর্ঘদিন বঞ্চিত চিকিৎসকদের যৌক্তিক পদোন্নতির দাবির ফাঁকে অনৈতিক কিছু দাবি আদায় করে নেওয়ার। চাপের মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এতে সহমত পোষণ করে আসছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে এখন আর সেই সুযোগ নেই বলে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জনকণ্ঠকে বলেন, যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতেই আমরা এখনো পদোন্নতি এবং বদলি করছি। এখানে তদবিরের কোনো সুযোগ নেই।


সিন্ডিকেট ভেঙে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে ৪ হাজার চিকিৎসককে ॥ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চিকিৎসকদের বদলি-পদোন্নতি একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা। তাদের কঠিন সিন্ডিকেটের বদৌলতে দিনের পর দিন পদবঞ্চিত থেকেছেন ভিন্ন মতের চিকিৎসকরা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বঞ্চিতদের তালিকা ধরে অন্তত ৪ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। 


সম্প্রতি, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরামের আন্দোলন ঠেকাতে তাদের সঙ্গে বসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাইদুর রহমান। এতে উভয় পক্ষ সম্মত হয় যে, ঈদের আগে/পরে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রায় ৪ হাজার চিকিৎসকের প্রথম ধাপে পদোন্নতি হবে।

পছন্দক্রম থাকুক বা না থাকুক মাদার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের সাব স্পেশালটিতে (যে বিষয়গুলোতে ডিগ্রি নেই) পদোন্নতি দিয়ে দেওয়া হবে। আগে পছন্দের বাইরে কোনো পদোন্নতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল এবং প্রার্থিত পদ পরিবর্তনেরও কোনো সুযোগ ছিল না। এক্ষেত্রে ‘ওয়ান স্টেপ’ পদোন্নতি হবে। অর্থাৎ এপি, অ্যাসোসিয়েট এবং প্রফেসর হবেন আপাতত একবার। পরে একে একে জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হবে। 


৭৫০০ পদ সৃজন ও নতুন ৩ হাজার নিয়োগ ॥ ৪৫, ৪৭ ও ৪৮ বিসিএসের মাধ্যমে তিন হাজারের বেশি নতুন চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, আরও দুই হাজার নতুন নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পিএসসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে। 


উপজেলা পর্যায়ে নিশ্চিত হচ্ছে ৫ হাজার চিকিৎক ॥ উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরও নতুন ৫ হাজার পদ সৃষ্টি প্রক্রিয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলমান আছে। শূন্যপদে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ৩৩তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতির জট কাটাতে সুপারনিউমারি পদ সৃজনের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

আগামী ১২ সপ্তাহের মধ্যে ৭ হাজার ৫০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্য সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি জানান, আগামী ৫-৬ সপ্তাহের মাঝে ১ম ফাইলের পদোন্নতির কাজ সম্পন্ন করবেন। এ ছাড়াও পিএসসির মাধ্যমে নতুন ২০০০ ডাক্তার নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।


ভেঙেছে পদায়ন সিন্ডিকেট ॥ স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় অনেক চিকিৎসক দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিলেন। তাদের ইতোমধ্যে পদায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতাদের জায়গায় হঠাৎ সক্রিয় হয় বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন এনডিএফ।

বদলি পদায়নে তাদের দাবি নিয়ে উভয় পক্ষই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। আওয়ামী সরকারের সমর্থিত স্বাচিপের চিকিৎসকদের সরিয়ে, দীর্ঘদিন বঞ্চিত বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসকদের ঢাকায় পদায়নের দাবিতে সরব হয় তারা। তবে মেধার ভিত্তিতেই সব পদায়ন হয়েছে বলে দাবি ওই কর্মকর্তার।

বেড়েছে চিকিৎসকদের ভাতাও ॥ বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নামেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকরা। উচ্চতর ডিগ্রি (এফসিপিএস, এমডি, এমএস) প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের মাসিক ভাতা দেওয়া হতো মাত্র ২৫ হাজার টাকা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের ভাতা বাড়িয়ে ৩৫ হাজার টাকা করেছে।

শর্ত হিসেবে যুক্ত করেছে, ঢাকার বাইরে তাদের কাজ করতে হবে। সে শর্ত অনুযায়ী জানুয়ারি মাস থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এমন চিকিৎসকরা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যোগদান করে প্রান্তিক মানুষের সেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া এমন অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা দীর্ঘ সময় উপজেলা পর্যায়ে পদায়িত থেকেও বিভিন্ন অনৈতিক তদবির কিংবা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ঢাকা/বিভাগীয় হাসপাতালে সংযুক্তিতে কাজ করতেন।

সেসব সংযুক্তি অবিলম্বে বাতিল করে চিকিৎসকদের পুনরায় উপজেলা পর্যায়ে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। ফলে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ সংযুক্তি বাতিল হয়েছে; অবিলম্বে ঢাকাসহ অন্য সব বিভাগীয় পর্যায়ের সংযুক্তির ক্ষেত্রেও এ নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানা গেছে।


এতে খুশি আন্দোলনকারীরাও। তারা বলছেন, গত প্রায় ২ বছর আমরা আমাদের ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেটি মানেনি। অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের কষ্ট বুঝেছে। সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। 


চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা ॥ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তন হয়েছে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার। এর জন্য রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। তাদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর জুলাই বিপ্লবে শহীদ ও আহতদের প্রকৃত সংখ্যা ও স্বরূপ নির্ণয় এবং আহতদের দেশী-বিদেশী চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছে। 


গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জানানো হয়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত রোগী অ্যাটেনডেন্ট এবং রোগীদের সঙ্গে থাকা একজন দোভাষীসহ আহতদের চিকিৎসা, যাতায়াত, আবাসন, খাবার, ভিসা ও পাসপোর্ট, ব্যাংক চার্জ ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

আন্দোলনে আহত ৪০ জন রোগীর বিদেশে চিকিৎসার খরচ, রোগীদের সঙ্গে থাকা ২৫ জন অ্যাটেনডেন্ট, দোভাষী খরচসহ অন্যান্য খরচ দেখানো হয়েছে ১৯ কোটি ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪০ টাকা। ব্যয়ের বিবরণ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ উপদেষ্টা পরিষদকে জানান। গুরুতর অবস্থার আরও কয়েক রোগীকে বিদেশ পাঠানো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। 


দৃশ্যমান আরও যত পরিবর্তন ॥ করোনাভাইরাস মহামারির সময় থেকেই আলোচনায় ছিল দেশের স্বাস্থ্য খাত। ভাইরাসটির টিকা আমদানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতালের সরঞ্জামাদি কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠে একের পর এক। অভিযোগ উঠে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে চলে আসা এই দুর্নীতির কর্মযজ্ঞ। এরই মধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শেষে গঠন হয় নতুন সরকারের।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডা. সামন্ত লাল সেন। সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর পারেননি। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব হারান তিনিও। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাংলাদেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তর। অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে বিবেচিত স্বাস্থ্য খাতের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান নূরজাহান বেগম। পরিবর্তন আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদেও।

শহীদ

×