
বিশ্ব কিডনি দিবস আজ
অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে দেশে প্রতি দিনই বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে দুই কোটিরও বেশি কিডনি রোগী রয়েছে। আর বছরে কিডনি বিকল হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষের। এ বাইরে আরও ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের কিডনি আকস্মিকভাবেও বিকল হচ্ছে। ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভর প্রায় ৪০ হাজার রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই রোগ দেশের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তবে তাদের দাবি, সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর এসব বিষয় নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ বৃহস্পতিবার পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস।
শ্যামলীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের তথ্যমতে, দেশে ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯০০ জন রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিয়েছেন। প্রতি বছর এর সঙ্গে ১ হাজার জন যোগ হয়। এ সংখ্যা মোট আক্রান্তের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বাকি কিডনি রোগে আক্রান্ত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ডায়ালাইসিস নিতে পারেন না। তার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। বাংলাদেশে এত মানুষকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়াও সম্ভব না বলেও জানান চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, সবাইকে এ সেবার আওতায় নিতে স্বাস্থ্যসেবায় আরও ৫ গুণ বেশি বাজেট প্রয়োজন হবে।
এ বিষয়ে কিডনি বিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ বলেন, কিডনি রোগীর বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন প্রয়োজন। কিন্তু কিডনি চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় শতকরা ১০ জন এর ব্যয় বহন করতে পারে। চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায়। সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন বিমার আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, কিডনি রোগীরা দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। আমরা জানি কিডনি রোগের ঝুঁকি ব্যাপক। বিশ্বে ৮৫ কোটি লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে দুই কোটিরও অধিক কিডনি রোগী। প্রতি বছর ৩৫-৪০ হাজার লোকের কিডনি সম্পূর্ণ বিকলের শিকার বাংলাদেশে। এদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ডায়ালাইসিস সাধারণত সপ্তাহে ২-৩ দিন করতে হয়। দুর্যোগের কারণে ডায়ালাইসিস বন্ধ হলে মৃত্যু এগিয়ে আসবে। কিডনি সংযোজনের রোগীদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে, ওষুধ নিয়মিত না খেলে সংযোজিত কিডনি বাতিল হয়ে যেতে পারে। আবার দুর্যোগের সময় আঘাত, রক্তক্ষরণ, দুর্যোগ পরবর্তী ডায়রিয়া ইনফেকশন এসব কারণে তীব্র মাত্রার আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে।
যার জন্য ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অল্প মাত্রার দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে সম্পূর্ণ কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। তখন ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হবে। তাই কিডনি রোগীরা দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
ডা. এম এ সামাদ আরও বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় কিডনি রোগীদের পূর্ব প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। যেমন- প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রস্তুত রাখা। বিকল্প ডায়ালাইসিস সেন্টার সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিয়ে রাখা। সাহায্যকারী নেটওয়ার্ক তৈরি করে রাখা। যেমন-বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের সহায়তা। ডায়ালাইসিস পেতে বিলম্ব হলে সাময়িক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন। যেমন- পানি কম, মাছ-মাংস কম, পটাশিয়াম যুক্ত খাবার যেমন- ফল ও সবজি পরিহার করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ীÑ কিডনি রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিডনি রোগ বাড়ছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত।
এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে ৫ম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগী কিডনি রোগের সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়।
কী ভাবে কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন-উর-রশিদ কিডনি রোগকে নীরব দুর্যোগ আখ্যায়িত করে বলেন, এ রোগের জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের আধিক্য বিবেচনায় প্রতিরোধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ রোগী জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিডনি রোগের জন্য ডায়াবেটিকস অন্যতম দায়ী।
তিনি বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি সারাদেশে ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এসব ক্লিনিকে যদি ১৫০ টাকা খরচ করে উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিন, ডায়াবেটিকস টেস্টের ব্যবস্থা করে তাহলে আমরা কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রিভেনশন করা যাবে।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে কিডনি রোগ বেড়েই চলছে। গত ১০ বছরে দেড় কোটি কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে এখন সাড়ে ৩ কোটি। তবে আমরা আশা রাখছি জেলা পর্যায়ে ডায়ালায়সিস সেন্টার চালু হচ্ছে। এতে সেবা সহজলভ্য হবে।
কীভাবে কিডনি ভালো রাখা যাবে- জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কিডনি ভালো রাখতে সবারই পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে। এই পানি অবশ্যই হতে হবে নিরাপদ। অসুস্থতায় (জ্বর, ডায়রিয়া, বমি প্রভৃতি) এবং ব্যায়ামের পর পানির চাহিদা বাড়ে। বিশেষত ডায়রিয়া বা বমি হলে পর্যাপ্ত পানি, স্যালাইন এবং অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে অবশ্যই। গর্ভবতী এবং স্তন্যদায়ী মায়ের জন্যও পানির চাহিদা বেশি।
কিডনি রোগের লক্ষণ ॥ ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব, প্রস্রাব কম হওয়া, পায়ে পানি আসা প্রভৃতি হতে পারে কিডনি রোগের লক্ষণ। চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলো এবং রোগের জটিলতার লক্ষণ সম্পর্কে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। রোগীর পরিবার কিংবা রোগীর সেবা দেন যিনি, তাদেরও বিষয়গুলো জানতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত লবণ কিডনির জন্য ক্ষতিকর। একজন সুস্থ ব্যক্তি দৈনিক ৫-৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, রান্নায় অনেকটা লবণ দেওয়াই আছে। তাই পাতে বাড়তি লবণ নেবেন না। সালাদ বা ফলের সঙ্গেও নয়। রান্না সুস্বাদু করতে বেশি লবণ ব্যবহার না করে বিভিন্ন রকম মসলা ব্যবহার করতে পারেন। ভাজা খাবারের চেয়ে সেদ্ধ খাবার ভালো। বেকড খাবার খেতে পারেন। বাড়তি তেল-চর্বি এড়িয়ে চলুন।