
গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা সরাসরি শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রভাবটি মূলত মায়ের শরীরে এবং মস্তিষ্কে ঘটে থাকা পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুর ওপর প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গর্ভবস্থায় অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং স্নায়ুবিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
১. মায়ের শরীরের প্রতিক্রিয়া: কর্টিসোল এবং অন্যান্য হরমোন
গর্ভবতী মায়ের দুশ্চিন্তা সাধারণত উচ্চ স্তরের স্ট্রেস হরমোন "কর্টিসোল" এর নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এই কর্টিসোল শিশুতে গর্ভকালীন সময়ে পৌঁছানোর ফলে শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণা অনুসারে, উচ্চ কর্টিসোল স্তরের কারণে শিশুর শরীরে হরমোনাল ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে, যা পরবর্তীতে শিশুর আচরণ এবং মানসিক উন্নয়নেও প্রভাব ফেলতে পারে।
২. প্রথম তিন মাসের মধ্যে প্রভাব
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং অন্যান্য শারীরিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় যদি মায়ের মধ্যে অধিক উদ্বেগ, মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা থাকে, তবে তা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রথম ত্রৈমাসিকের সময় মায়ের শারীরিক ও মানসিক চাপ শিশুর মস্তিষ্কের কাঠামো এবং স্নায়ুগ্রন্থীর কার্যকারিতা পরিবর্তন করে দিতে পারে।
৩. দুশ্চিন্তার প্রভাব শিশুর মানসিক এবং আচরণগত বিকাশে
গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ শিশুর ভবিষ্যত আচরণগত সমস্যাগুলির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মায়ের দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগের শিকার শিশুরা পরবর্তী সময়ে উদ্বেগ, ডিপ্রেশন বা আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে, শিশুদের মধ্যে আচরণগত অস্থিরতা, স্কুলে মনোযোগের অভাব, অথবা আত্মবিশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. বিশেষজ্ঞদের মতামত: মানসিক চাপের দূষিত প্রভাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে যে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপের কারণে সন্তানের আত্মবিশ্বাসের সমস্যা, ভাষাগত দক্ষতা হ্রাস, এবং শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে। ২০১০ সালের একটি গবেষণায় ( The Lancet Psychiatry) প্রকাশিত হয় যে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ শিশুর মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি, এই ধরনের প্রভাব শিশুদের ভবিষ্যতের জীবনযাত্রার মানের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
৫. শিশুর জন্মগত সমস্যার ঝুঁকি
গর্ভবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শিশুর জন্মগত সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মানসিক চাপ শিশুর জন্মের সময় নিম্ন ওজন, প্রিম্যাচিউর (অতিরিক্ত পূর্ববর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ), শ্বাসকষ্ট, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, গর্ভবতী মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য এবং দুশ্চিন্তা তার শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, এবং বিশেষত গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ বিকাশ সম্ভব হয়।
মুহাম্মদ ওমর ফারুক