ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১

ধূমপান ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায়

ড. অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ধূমপান ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায়

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তার প্রতিষ্ঠা দিবসকে ডায়াবেটিক সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়, ২০২৫ সালে দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিস : ঝুঁকি জানুন। শনাক্ত করুন। পদক্ষেপ নিন।’ প্রতিরোধের এখনই সময়’।
প্রতিদিন যেমন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি, বাড়ছে ডায়াবেটিক রোগীদের নানা ধরনের জটিলতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডায়াবেটিস-কে মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করা করেছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন তা হচ্ছে-দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শারীরিক সক্রিয়তা কম এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ না করা। বড় উদ্বেগের বিষয় আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪কোটি মানুষ তামাক, ধূমপান সেবন করে। সুতরাং বিরাট অংশের জনগোষ্ঠি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে।
ধূমপান, তামাক সেবনের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক কী?
গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধূমপান টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর একটি কারণ, প্রকৃতপক্ষে, যারা সিগারেট পান করেন তাদের ধূমপান না করা লোকদের তুলনায় টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা ৩০%-৪০% বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন, তাদের ইনসুলিন ডোজ বা মাত্রা কার্যকর করতে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা বেশি। একজন ধূমপায়ী যত বেশি সিগারেট পান করবেন, তার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তত বেশি। যে ধরনের ডায়াবেটিস থাকুক না কেন, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা আরও শক্ত করে তোলে। যদি কারো ডায়াবেটিস হয় এবং তিনি যদি ধূমপান করেন তবে ডায়াবেটিস থেকে তাঁর বিভিন্ন জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন, হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং পায়ে দুর্বল রক্ত প্রবাহ যা সংক্রমণ, আলসার এবং সম্ভাব্য পা কেটে ফেলার কারণ হতে পারে (পায়ের আঙ্গুল বা পায়ের অংশ অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে শরীরের কোনও অংশ কেটে ফেলা) তাছাড়াও রেটিনোপ্যাথি চোখের রোগ যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হাতে ও পায়ে ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ু যা অসাড়তা, ব্যথা, দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
ধূমপান ছেড়ে দিলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৩০-৪০% পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস বিশ^ব্যাপী সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর মধ্যে একটি, যা সব ধরনের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ৯৫% এরও বেশি। ধূমপান ত্যাগ করা কেবল টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিই হ্রাস করে না, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও অনেক সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিসের জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস করে। গবেষণা প্রমাণ করে যে, ধূমপান রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। ধূমপান ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, কিডনি জটিলতা এবং অন্ধত্বের ঝুঁকিও বাড়ায়। ধূমপান ক্ষত নিরাময়ে বাধা সৃষ্টি করে এবং নিম্ন অঙ্গ পঙ্গুত্বের ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর একটি উল্লেযোগ্য বোঝা তৈরি করে। তামাকজাত পণ্যগুলোতে পাওয়া নিকোটিন একটি রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থ যা রক্তে শর্করাকে বাড়িয়ে তোলে। সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্যগুলোর রাসায়নিক পদার্থ দেহের ক্ষতি করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে (প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে)। দেহের এই প্রদাহ এবং নিকোটিন উভয়ই দেহের রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে তোলে। যারা ধূমপান করেন তাদের পেটের চর্বি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে, এমনকি তাদের ওজন যদি বেশি নাও থাকে।
ধূমপান এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা :
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং এবং ধূমপান সেটাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। যেহেতু নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ধূমপান ছেড়ে দেওয়া কেন প্রয়োজন :
আপনি কতবার ধূমপান করেছেন-বা কখন ছেড়ে দিলে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। আপনি যখন ধূমপান বন্ধ করবেন সেই সময় থেকে আপনার শরীর নিজেই নিরাময় শুরু করবে। যেমন: ১২ ঘন্টার মধ্যে, আপনার রক্তে কার্বন মনোক্সাইড (সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একটি বিষাক্ত গ্যাস) স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাসের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন এবং ফুসফুস আগের চাইতে উন্নত হবে। এক বছরের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন অনেক বেশি স্বাভাবিক হবে। এক বছরের মধ্যে আপনার হৃদরোগ ঝুঁকি যারা এখনো ধূমপান করে এমন ব্যক্তির চেয়ে অর্ধেক নেমে আসবে। ধূমপান ত্যাগ করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ করতে সহায়তা করে। শরীর ধূমপান মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়া পর্যন্ত রক্তে শর্করার পরিমাণ ঘন ঘন পরীক্ষা করতে হবে।
ধূমপান ছাড়ার জন্য সাহায্য প্রয়োজন :
নিকোটিন পণ্য যেমন নিকোটিন প্যাঁচ এবং লজেন্স ধূমপান বন্ধ করতে সহায়তা করার জন্য করতে পারে। এগুলো সরঞ্জাম ব্যবহারে ছাড়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নিকোটিনযুক্ত পণ্যগুলো রক্তে শর্করাকে বাড়িয়ে তোলে, তাই যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে সেগুলো ব্যবহার সম্পর্কে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। প্রথম চেষ্টায় ছাড়তে সক্ষম না হলেও হাল ছাড়া ঠিক হবে না। পিছলে গেলেও মন খারাপ করার দরকার নেই, ভালোর জন্য ধূমপান মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা নিতে হতে পারে।
নিকোটিন কিভাবে রক্তে শর্করা প্রভাবিত করে?
নিকোটিন কোষগুলোতে রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো পরিবর্তন করে। যাতে তারা ইনসুলিনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। কোষগুলোর প্রয়োজন যাতে তারা রক্ত থেকে গ্লুকোজ নিতে পারে এবং এটি শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। যখন তারা পারে না, তখন গ্লুকোজ রক্তে থাকে এবং রক্তে শর্করা মাত্রা বেড়ে যায়। নিকোটিন শরীরকে আরও ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি করতে ট্রিগার করতে পারে, যা হচ্ছে ইনসুলিন প্রতিরোধের সাথে যুক্ত এক ধরনের ফ্যাট। অন্যদিকে নিকোটিন হরমোনের  মাত্রা  বাড়ায়। যা ইনসুলিনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ধূমপান কোষের ইনসুলিন ব্যবহারের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে বেশি সময় নেয় না। গবেষণায় দেখা গেছে যে যাদের ডায়াবেটিস এবং যারা ধূমপায়ী তাদর রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিনের বেশি ডোজ প্রয়োজন হয়।
ধূমপায়ীদের যখন রক্তের গ্লুকোজ কয়েক বছরের জন্য নিয়মিত খুব বেশি থাকে, তখন এটি হৃদরোগ এবং কিডনি, স্নায়ু এবং চোখের ক্ষতি সাধন করতে পারে। ধূমপায়ী যত বেশি সিগারেট পান করবেন তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। যারা ধূমপান করেন তাদের সম্ভাবনা ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। দিনে ২০টির বেশি সিগারেট খেলে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করার পর থেকে রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে তুলতে পারে। যেমন: পরোক্ষ ধূমপানের ধোঁয়া যিনি ধূমপান না করছেন না তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (অন্য ব্যক্তির সিগারেট থেকে ধোঁয়ার মাধ্যমে শ্বাস ফেলা) তামাক চিবানো (জর্দা, গুল, দোক্তা, সাদাপাতা)।
সুতরাং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্র্দা, গুল, সাদাপাতা অথবা বর্তমান সময়ে নতুন আমাদানি ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক সিগারেট সবই ডায়াবেটিস রোগের যেমন কারণ হতে পারে, তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সেই সঙ্গে অন্যান্য জটিল রোগ যেমন: হৃদরোগ, অন্ধত্ব ও নার্ভের সমস্যাসহ পায়ের পঁচনশীল রোগ গ্যাংগ্রীন হতে পারে। অতএব, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও জীবন যাপন পরিবর্তন করতে হবে তেমনি ধূমপান ও তামাক জাতীয় সকল বস্তু জর্দা, গুল, সাদাপাতা জীবন থেকে বর্জন করতে হবে। এভাবেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। ধূমপান করা ও তামাক (জর্র্দা, গুল, খৈনি, সাদাপাতা) খাওয়া বাদ দিতে হবে।
ডায়াবেটিস কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
তামাকজাতীয় দ্রব্য বিশেষত : ধূমপান, জর্দা, গুল, সাদাপাতা ডায়াবেটিসের বড় কারণ হতে পারে। বিশেষত: ধূমপান আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়, ওজন বেশি হলে ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক জরুরি। জর্দা, গুল, সাদাপাতা মুখের বিভিন্ন ঘাঁ/ক্ষত সৃষ্টি করে এবং সেখান থেকে ক্যান্সারও হতে পারে।
ধূমপান ছেড়ে দিতে নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, তবে অনেক ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। ধূমপান ত্যাগ করলে নিজেকে যেমন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি পরিবার বা পারিপাশ্বিক জনসাধারণের জীবন ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। তাই আজই ধূমপান ও তামাক ছাড়ুন। ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি ও জটিলতা থেকে মুক্ত থাকুন।

লেখক : একুশে পদপ্রাপ্ত, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস- মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা Email : [email protected],
Phone: ০১৭১৩-০০২৩৭৬

×