ছবি: সংগৃহীত
শিশুদের নিয়মিত খাওয়ানো অনেক বাবা-মায়ের জন্য একটি কঠিন কাজ। প্রতিদিন শিশুকে খাওয়ানোর সময়ের জন্য একটি সঠিক সময়সূচী তৈরি করা, খাবারের প্রতি তাদের আগ্রহ জাগিয়ে রাখা, এবং একই সঙ্গে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, একে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত করতে পারে। তবে, স্মার্টফোন এবং টেলিভিশন অনেক বাবা-মায়ের জন্য সহজ সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যস্ততার কারণে শিশুকে শান্ত রাখতে এবং তাদের খাওয়ানোর সময় সহজ করতে অনেক বাবা-মা তাদের সামনে মোবাইল চালিয়ে দেন। কিন্তু, এই সহজ সমাধানটি দীর্ঘমেয়াদে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে, যার ফলস্বরূপ, শিশুর মধ্যে মোবাইল ও টিভি দেখার বদভ্যাস তৈরি হয় যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। যা পরবর্তীতে শিশুর নানা ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। তাহলে সমাধান? চলুন জেনে নেই খাওয়ার সময় শিশুর ফোনের আসক্তি কীভাবে কাটাবেন:
শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি:
১. শারীরিক সমস্যা:
দীর্ঘ সময় মোবাইল বা টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা শিশুর চোখের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর ফলে চোখে অস্বস্তি, চোখের সাদা অংশে লালচেভাব, ড্রাই আই এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। এটি এক ধরনের চোখের চাপ তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে গুরুতর চোখের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, স্ক্রিনের সামনে বেশি সময় থাকা শিশুর শারীরিক গতিশীলতা হ্রাস পায়, যার ফলে তাদের শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয় এবং স্থূলতা (obesity)-এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
২. মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা:
শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। যখন শিশুরা অতিরিক্ত সময় মোবাইল বা টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের মনোযোগ এবং চিন্তা শক্তি কমে যায়, যা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। স্ক্রিনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি শিশুর পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা বা সৃজনশীলতার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে সমস্যা হতে পারে।
৩. সামাজিক দক্ষতা কমে যাওয়া:
শিশুদের ফোন বা টিভি দেখার বদভ্যাস তাদের সামাজিক দক্ষতা উন্নত করতে বাধা সৃষ্টি করে। যখন তারা সারা দিন স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, তখন তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে কম কথা বলে এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা বা মিথস্ক্রিয়া করে না। এটি তাদের সামাজিক সম্পর্কের দক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে তাদের সমস্যা হয়।
মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব:
শিশুদের উপর স্ক্রিনের অতিরিক্ত প্রভাব মানসিকভাবে খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোন বা টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ, এবং অতিরিক্ত স্ট্রেস তৈরি হতে পারে। শিশুদের জন্য মোবাইলের স্ক্রিন অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু এর প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তাদের মনের মধ্যে উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে তাদের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারে শিশুদের মধ্যে এক ধরনের “ফOMO” (Fear of Missing Out) তৈরি হতে পারে, যা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে।
এটা কিভাবে কাটাবেন?
১. সৃজনশীল এবং আকর্ষণীয় বিকল্প প্রদান করুন:
খাওয়ার সময় শিশুকে মোবাইল বা টিভির বদলে সৃজনশীল কাজের দিকে আগ্রহী করুন। যেমন, গল্প বলা, গান গাওয়া, আঁকা বা গল্পের বই পড়া। এই ধরনের ক্রিয়াকলাপ শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং তারা ফোন বা টিভির প্রতি আগ্রহ হারাবে।
২. নিয়মিত সময়সূচী গঠন করুন:
শিশুকে খাবার সময় মোবাইল না দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। নিয়মিত সময়সূচী তৈরি করুন, যাতে খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার না করা হয়। বাবা-মা যদি নিজেদেরকে এই নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করেন, তাহলে শিশুও এটিকে সহজেই মেনে নিতে শিখবে।
৩. ইতিবাচক অভিভাবকত্ব:
শিশুদের স্মার্টফোন বা টিভি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি ফোন ব্যবহার না করার ভালো উদাহরণ তৈরি করেন, তবে শিশুরাও সহজেই এই আচরণ মেনে নেবে। একসঙ্গে খাবার খাওয়া, গল্প বলা, এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো শিশুর মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করবে।
৪. খাওয়ার সময় সম্পর্ক গড়ে তোলা:
শিশুর সাথে খাওয়ার সময় সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করা এবং একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানো শিশুদের জন্য খুবই উপকারী। এটি তাদের শুধু সামাজিকভাবে নয়, মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
৫. সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার:
যদি শিশুর মোবাইল ব্যবহার একেবারে এড়ানো না যায়, তবে “প্যারেন্টাল কন্ট্রোল” অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এই অ্যাপগুলি শিশুর ফোনের ব্যবহারের সময়, অ্যাপ্লিকেশন এবং স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে। তবে, এটি শুধুমাত্র একটি সহায়ক উপায়; মা-বাবার সচেতনতা এবং পিতামাতার গাইডলাইন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রেজা