বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আজ
দেশে প্রতি লাখে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই মারা যাচ্ছে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি লাখে ৫৩ জন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য প্রকাশ হয়েছে।
বিশ্ব ক্যান্সার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গ্লোবকোনের (জিসিও) তথ্যমতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য একটি ক্যান্সার সেন্টার প্রয়োজন। সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ২২টি। প্রতি ১ লাখ লোকের জন্য ১ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ থাকার কথা থাকলেও দেশে সব মিলিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র তিনশ’ জন। নেই পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিও।
ফলে অনেক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীই পাচ্ছেন না সঠিক চিকিৎসা। চিকিৎসাখাতে বাড়ছে বিদেশমুখিতা। এমন পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’ অর্থাৎ ‘স্বকীয়তা মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হই’।
ভুক্তভোগীদের যত দুর্ভোগ ॥ একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন নাদিয়া তাবাসসুম (ছদ্মনাম)। এক ভাই আর তিন বোনের সংসারের হাল ধরেছেন নিজেই। অসুস্থ বাবার চিকিৎসাসহ পুরো পরিবারের ব্যয় বহন করেন একাই। হঠাৎ একদিন অফিস চলাকালে প্র¯্রাবের রাস্তায় তীব্র জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। পানি কম খাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে মনে করে পাত্তা না দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
কিন্তু পরের দিনও একই অবস্থা। জ্বালাপোড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে অফিস ছুটি নিয়ে সরাসরি চলে যান হাসপাতালে। চিকিৎসক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত নাদিয়া। হাসিখুশি পরিবারটিতে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। চিকিৎসক প্রথমে কেমোথেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দিলে কম খরচের জন্য রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে যান। কিন্তু সেখানে রোগীদের দীর্ঘ লাইন আর দুর্গন্ধময় পরিবেশে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বাধ্য হয়ে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিচ্ছেন থেরাপি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাদিয়া বলেন, ‘এই বয়সে জরায়ুমুখে ক্যান্সার হবে তা স্বপ্নেও মনে আসেনি। চাকরি তো ছাড়তেই হলো চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারকে কয়েকদিন পর হয়তো পথে বসতে হবে। দেশে এমন কোনো ভালো ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র নেই যেখানে একটু ভালো সেবা পাওয়া যাবে।’
একই আক্ষেপে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভিসার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন সংবাদকর্মী সীমা রহমান (ছদ্মনাম)। গলায় ক্যান্সার আক্রান্ত বাবাকে রাজধানীর ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রেডিওথেরাপি দিতে নিয়ে গেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয় দেশে আর চিকিৎসা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ভারতের ভিসা পেতে দেরি হচ্ছে।
তাই একটু ক্ষোভ নিয়েই সীমা বলেন, দেশ এত এগিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থায় তো কোনো পরিবর্তন আসলো না। এখনো হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর দেশের বাইরে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আর কোনো উপায় না দেখে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হবে কবে।’
দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর চিত্র ॥ নীরব ঘাতক ক্যান্সারে দিনের পর দিন দেশে আক্রান্ত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, অতিরিক্ত ধূমপান, মাদকগ্রহণ, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে নানা ধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
বিশ্ব ক্যান্সার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গ্লোবকোনের (জিসিও) তথ্যমতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ। এদের বেশিরভাগই শনাক্ত হয় একেবারে শেষ সময়ে। ফলে প্রতিবছর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় অন্তত: দেড় লাখ মানুষের।
দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের নিয়ে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চালিয়েছে। এতে প্রাথমিকভাবে ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের মধ্যে থেকে ২ লাখ ১ হাজার ৬৬৮ জন গবেষণায় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন, যার মধ্যে ৪৮.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১.৬ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৪ জন।
গবেষণায় ৩৮ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ চিহ্নিত হয়েছে। এদের মধ্যে ৯২.৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগী ১৮-৭৫ বছর বয়সী। ১৮ বছরের নিচে ২.৪ শতাংশ এবং ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫.১ শতাংশ ছিলেন। সর্বোচ্চ ৫ ধরনের ক্যান্সার ছিল : স্তন (১৬.৮ শতাংশ), ঠোঁট, মুখ গহ্বর (৮.৪ শতাংশ), পেট (৭.০ শতাংশ), গলা (৭.০ শতাংশ) ও জরায়ু (৫.১ শতাংশ)।
এর মধ্যে পুরুষদের গলার ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি ছিল (১৩.০ শতাংশ)। অন্যান্য প্রধান ক্যান্সার ছিল পেট (১০.৪ শতাংশ), ফুসফুস (৮.৭ শতাংশ), ঠোঁট ও মুখ গহ্বর (৭.০ শতাংশ) ও খাদ্যনালী (৬.১ শতাংশ)।
নারীদের স্তন ক্যান্সার ছিল সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার (৩৬.৪ শতাংশ)। এ ছাড়া, অন্যান্য প্রধান ক্যান্সার ছিল জরায়ু (১১.১ শতাংশ), ঠোঁট ও মুখ গহ্বর (১০.১ শতাংশ), থাইরয়েড (৭.১ শতাংশ) এবং ডিম্বাশয় ক্যান্সার (৫.১ শতাংশ)। ১৯ শতাংশ মহিলা ক্যান্সার রোগী প্রজনন সিস্টেমের ক্যান্সারে আক্রান্ত (জরায়ু মুখ ১১ শতাংশ, ডিম্বাশয় ৫ শতাংশ, ও জরায়ু ৩ শতাংশ)।
ক্যান্সার রোগীদের সহ-রোগের মধ্যে ছিল উচ্চ রক্তচাপ (১৭ শতাংশ), ডায়াবেটিস (১১ শতাংশ), হৃদরোগ (৬ শতাংশ), দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (৩ শতাংশ), ও স্ট্রোক (২ শতাংশ)।
৭৫.৮ শতাংশ পুরুষ ক্যান্সার রোগী ছিলেন ধূমপায়ী। ৪০.৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৬০.৬ শতাংশ নারী তামাক সেবন করতেন। সর্বমোট ক্যান্সারের ৪৬ শতাংশ তামাক (ধূমপান ও তামাকবিহীন) সেবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ৬০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সংমিশ্রণ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ৭.৪ শতাংশ রোগীকে কোনো চিকিৎসা প্রদান করা হয়নি।
সারাবিশ্বে ক্যান্সারের চিত্র ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে, যা ২০২২ সালের চেয়ে অন্তত ৭৭ শতাংশ বেশি।
ক্যান্সার দিবস পালনের উদ্দেশ্য ॥ দিবসটি আয়োজনের সঙ্গে জড়িতরা বলছে, ক্যান্সার দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো মারাত্মক ও প্রাণঘাতী এই কর্কট রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া এবং এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের সাহায্য করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা। ক্যান্সার একটি বড় রোগ, যার সময়মতো চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রতিবছর বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়।
চিকিৎসকরা মনে করেন, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের রোগ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে এবং সেক্ষেত্রে চিকিৎসা সহজ হয়।
চিকিৎসায় যত প্রতিবন্ধকতা ॥ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. এটিএম কামরুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে ক্যান্সার সেবায় প্রতিবন্ধকতাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়- ১. ব্যক্তিগত ২. পারিবারিক, ৩. সামাজিক ও ৪. প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা। ব্যক্তিগত কারণগুলোর মধ্যে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ক্যান্সারে যে লক্ষণগুলো গুরুত্ব না দেওয়া, সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হওয়া।
পারিবারিক বাধার প্রধান কারণ আর্থিক সামর্থের অভাব। যার ফলে বেশির ভাগ রোগী শেষ ধাপে চিকিৎসা নিতে আসে। সমাজে ক্যান্সার রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা ক্যান্সার চিকিৎসায় বড় অন্তরায়। ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসা নাই, ক্যান্সার এক ধরনের অভিশাপ, ক্যান্সারের চিকিৎসা করলে তাড়াতাড়ি মারা যাবে, চুল- দাঁড়ি পড়ে যাবে, ক্যান্সার ছোঁয়াচে তাই ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে মেশা যাবে না ইত্যাদি। সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে এইসব ভুল ধারণা দূর করতে হবে। ক্যান্সার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়, বেশির ভাগ ক্যান্সারের চিকিৎসা আছে তা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ক্যান্সার চিকিৎসক মাত্র ৩০০ জন ॥ ক্যান্সার চিকিৎসা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের পাশাপাশি রয়েছে চিকিৎসকের সংকটও। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য ১টি ক্যান্সার সেন্টার প্রয়োজন সেখানে সারাবাংলাদেশে ২০-২২টি সেন্টার আছে। প্রতি ১ লাখ লোকের জন্য ১ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৩০০ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন।
প্রতিষেধকের চাইতে প্রতিরোধ জরুরি ॥ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যান্সার যেন না হয় সেজন্য মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ক্যান্সার প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব দেওয়া এবং ধূমপান পরিহার করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোসহ নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর জনকণ্ঠকে বলেন, সমস্যা হচ্ছে আমাদের প্রকৃত ক্যান্সার রোগী কেমন সেই প্রকৃত সংখ্যা আমরা জানি না। আমাদের কাছে তথ্য আছে, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সামগ্রিক যে তথ্য দরকার একটি দেশের জন্য সেটা কিন্তু আমরা জানি না। আমাদের দেশে ক্যান্সার কন্ট্রোল স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সেখানে স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি করণীয়টা ছিল না। না থাকার কারণে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি একটু পিছিয়ে পড়েছিল।
বছরজুড়ে নষ্ট থাকে রেডিওথেরাপি মেশিন ॥
দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। স্বল্পমূল্যে প্রায় সব ধরনের ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা পাওয়ায় সারাদেশ থেকে এই হাসপাতালে আসেন রোগীরা। ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের আশায় রোগীরা এই হাসপাতালে প্রতিদিনই ভিড় করলেও খোদ হাসপাতালটিই যেন ক্যান্সারে আক্রান্ত। হাসপাতালটিতে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ৬টি।
কিন্তু প্রায় ২ বছর যাবত এর মধ্যে ৫টিই নষ্ট। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে আবার কয়েকটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়েছে ব্যবহারের কার্যকারিতা। নেই একটিও এমআরই মেশিন। হাসপাতালজুড়ে রয়েছে মাত্র একটি এক্সরে মেশিন। সেটিও নষ্ট ১ বছরের বেশি সময় ধরে। সর্বোপরি রয়েছে তীব্র জনবল সংকট।
৩শ’ বেডের হাসপাতালের জনবল নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ৫শ’ বেডের বিশাল এই হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম। ফলে দিনের পর হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।