ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১

ফুসফুস ক্যান্সার সম্পর্কে যা যা জানা প্রয়োজন 

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৮:১৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ফুসফুস ক্যান্সার সম্পর্কে যা যা জানা প্রয়োজন 

ছবিঃ সংগৃহীত।

সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সারের ভিন্ন ভিন্ন ধরণ ও ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখেছে মানবসভ্যতা। ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রতিটি রোগীর অভিজ্ঞতা এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্পগুলোও ব্যতিক্রম। তাই সবার ব্যতিক্রমিতাকে সম্মান জানাতে ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’ থিম নিয়ে প্রতিবারের মতো এবছরেও পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস।         

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সার সবচেয়ে মারাত্মক হিসেবে পরিগণিত হয়। এর বেশ কিছু কারণ থাকলেও ধূমপানকে ফুসফুসের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন, টার, আর্সেনিকের মতো প্রায় ৬৯টির বেশি রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যারা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ধূমপানের পর ফুসফুসে অবশিষ্ট থাকা নিকোটিন ও টার ফুসফুসে ক্যান্সারের কোষ গঠন করে। এমনকি যারা আগে ধূমপান করতেন তবে এখন ত্যাগ করেছেন বা পরোক্ষ ধূমপায়ী, তারাও ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান কার্সিনোজেন ধূমপায়ী ও দীর্ঘসময় ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিরাও ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারেন। ধূমপানে ফুসফুসের আস্তরণের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরে প্রবেশকৃত ধোঁয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ধূমপানের ফলে তা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে ফলে ফুসফুস সহজেই ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে। 

এছাড়া, কয়লা খনির শ্রমিক, বিল্ডিং নির্মাণ শ্রমিক, পেট্রোলিয়াম, কেমিক্যাল বা রাবার কারখানার শ্রমিক, জাহাজ শ্রমিক, এক্স-রে বিভাগে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়ার কাজ করে এমন কর্মীরাও ফুসফুস ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।   

উপসর্গসমূহ – 
ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উপসর্গ থাকে না। তবে, ক্যান্সারের অবস্থা অনুযায়ী ধীরে ধীরে উপসর্গগুলো দেখা দেয়। ক্রমাগত কাশি বা স্মোকারস কফ, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, নিশ্বাসকালীন বুকে ব্যথা, গলা ভাঙ্গা, ওজন হ্রাস, হাড় ও মাথাব্যথা ইত্যাদি ফুসফুস ক্যান্সারের কিছু উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে, যারা চেইন স্মোকার বা নিয়মিত ধূমপায়ী তাদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করানো উচিৎ।  

ধরণ – 
ফুসফুসের ক্যান্সার সাধারণত দুই প্রকার হয়; স্মল সেল লাং ক্যান্সার (এসসিএলসি) এবং নন-স্মল সেল লাং ক্যান্সার (এনএসসিএলসি)। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা ক্যান্সারের ধরণ ও অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।    

ঝুঁকিসমূহ - 
ধূমপান ছাড়াও পরোক্ষ ধূমপান, রেডন গ্যাস, অ্যাসবেস্টস ও কার্সিনোজেন এবং বংশগত ইত্যাদি ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। মাটি, পাথর এবং পানিতে ইউরেনিয়াম ভেঙে রেডন গ্যাস উৎপন্ন হয়। রেডন টেস্টিং কিট বাতাসে রেডনের উপস্থিতি সনাক্ত করে। রেডনের মাত্রা নির্ধারিত থাকে। যদি বাতাসে রেডনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি থাকে তাহলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্টপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। অ্যাসবেস্টস ছাদযুক্ত বাড়িতে থাকলে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। অ্যাসবেস্টসে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও নিকেল থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপায়ীদের ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য সিটি স্ক্যান করানো হয়। ৫৫ বা এর বেশি বয়সীদের ধূমপানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিৎ কারণ তাদের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।   

পরীক্ষা পদ্ধতি –
ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি বোঝার জন্য স্পুটাম সাইটোলজি পদ্ধতিতে মাইক্রোস্কোপ দ্বারা থুতু পরীক্ষা করা হয়। বায়োপসি’র মাধ্যমে ফুসফুসের কোষে ক্যান্সারের উপস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। ব্রোকোস্কোপ দ্বারা ফুসফুসে ক্যান্সারের অবস্থান সনাক্ত করা হয় ও মিডিয়াস্টিনোস্কোপি দ্বারা লিম্ফ নোডস থেকে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহের জন্য ঘাড়ের গোড়ায় ছিদ্র করা হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান করা হয়। ইমেজ টেস্ট এবং এক্স-রেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে দ্বারা বুকে ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কোষ বা সেলগুলো সংগ্রহ করা হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের পর্যায় শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সার সেল অধ্যয়ন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রথম পর্যায়ে, ক্যান্সার সেল শুধুমাত্র ফুসফুসে সীমাবদ্ধ। ফুসফুসের ক্যান্সারের দ্বিতীয় ধাপে দেখা যায় ক্যান্সার চেষ্ট ওয়াল ও ডায়াফ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুসফুসের ক্যান্সারের তৃতীয় ও চূড়ান্ত ক্যান্সার ফুসফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। 

ক্যান্সারটি কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ধারণে পিইটি সিটি স্ক্যান বা অন্যান্য রেডিওলজিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। দুর্ভাগ্যবশত সঠিক স্ক্রিনিং ও সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ ফুসফুস ক্যান্সার চতুর্থ পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। ফলস্বরূপ, ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই, ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে বাড়তি সচেতনতা আবশ্যক।  

চিকিৎসা – 
ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসা রোগের পর্যায় বা অবস্থার ওপর নির্ভর করে। কখনও কখনও এক বা একাধিক চিকিত্সার প্রয়োজনও হতে পারে। যার মধ্যে; কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি বা টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি উল্লেখযোগ্য। সার্জারি হলে ফুসফুসের ছোট, বড়, পুরো লোব এমনকি সম্পূর্ণ ফুসফুসও অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারির ক্ষেত্রে রক্তপাত ও ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে, তাই অবশ্যই ভালো হসপিটাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সার্জারি করাতে হবে। এভারকেয়ার হসপিটাল ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যাপক সমাদৃত। 

রিসপিরেটরি থেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রাথমিক সুস্থতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। সার্জারির আগে-পরে রোগীর যথাযথ যত্ন নিতে হয়। সঠিক যত্ন রোগীর উপসর্গ কমতে সাহায্য করে। সঠিক যত্নই পারে রোগীকে একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে। এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকায় আছে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি সুপার-স্পেশালিটি টারশিয়ারি কেয়ার ইউনিট, যেখানে অত্যাধুনিক চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার এবং ডায়াগনস্টিক সুবিধাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি তাদের বিশেষ মেডিকেল টিম চিকিৎসা পরবর্তী সময়েও রোগীকে সার্বিক পর্যবেক্ষণে রাখে এবং দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়তা করে। 

সব দিক বিবেচনা করে, ক্যান্সার সনাক্ত ও চিকিৎসায় কোন প্রকার অবহেলা না করে দ্রুত প্রদক্ষেপ নেওয়াই শ্রেয়। ক্যান্সার হতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে, ধূমপান ত্যাগ করে লাইফস্টাইল পরিবর্তনে মনোযোগী হওয়া উচিৎ। 


লেখকঃ 
ডাঃ ফেরদৌস শাহরিয়ার সাঈদ
সিনিয়র কনসালটেন্ট ও কোঅর্ডিনেটর
মেডিকেল অনকোলজি
এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা।

মুহাম্মদ ওমর ফারুক

×