আমরা অনেকেই শুনেছি, "তেলাকুচার ফল খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়!" কিন্তু সত্যটা কি জানেন? এটি নিছকই একটি ভ্রান্ত ধারণা! এই বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই! আসলে, তেলাকুচার শাক ও ফল উভয়ই খাওয়ার উপযোগী এবং এতে রয়েছে অসাধারণ পুষ্টিগুণ ও ঔষধি গুণাবলী।
তেলাকুচা একটি লতানো উদ্ভিদ। পঞ্চভূজ আকারের পাতা গজায়, পাতা ও লতার রং সবুজ।তেলাকুচা, বসতবাড়ির আশেপাশে, রাস্তার পাশে, বন-জঙ্গলে জন্মায় এবং বংশবিস্তার করে। সাধারণত বাংলা চৈত্র-বৈশাখ মাসে তেলাকুচা রোপন করতে হয়। পুরাতন মূল শুকিয়ে যায় না বলে গ্রীস্মকালে মৌসুমী বৃষ্টি হলে নতুন করে পাতা গজায় এবং কয়েক বছর ধরে পুরানো মূল থেকে গাছ হয়ে থাকে।
শীতকাল ছাড়া সব মৌসুমেই তেলাকুচার ফুল ও ফল হয়ে থাকে। ফল ধরার ৪ মাস পর পাকে এবং পাকলে টকটকে লাল হয়।অনেক অঞ্চলে এটি বিভিন্ন সবজির সাথে শাক হিসেবেও খাওয়া হয়। এটি লতানো উদ্ভিদ। এর ফল ও কচি ডগা কোন কোন এলাকায় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খাবার হিসেবে পাতা এবং ফল খাওয়া হয়। তেলাকুচার কাঁচা ফল তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়, পাতা শাক হিসেবে ভেজে খাওয়া যায়।
এছাড়া কাঁচা ফল এবং কচি পাতা দিয়ে সুপ এবং সালাদ তৈরি করা হয়। কাঁচা ফল পটলের মত চিরে দুইভাগ করে ভেজে খাওয়া যায়। থাইল্যান্ডে বিভিন্ন তরকারি এবং সুপে ফল ব্যবহার করা হয়। সেখানে এটি চাষ হয়। ভারত ও বাংলাদেশে খাওয়া হলেও চাষ হতে দেখা যায় না।
তেলাকুচার পুষ্টিগুণ
স্বাদের পাশাপাশি তেলকুচা অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ। একশো গ্রাম তেলাকুচায় প্রোটিন ১.২ গ্রাম, ১.৪ মিলি গ্রাম আয়রন, ০.০৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লোবিন), ০.০৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১ (থায়ামিন), ১.৬ গ্রাম আঁশ এবং ৪০ মিলি গ্রাম ক্যালশিয়াম থাকে। তেলাকুচা ভিটামিন এ এবং সি সমৃদ্ধ। তাছাড়া এতে প্রচুর বিটা-ক্যারোটিন আছে।
ঔষধি গুণাগুণ
তেলাকুচা অনন্য গুণাবলী সমৃদ্ধ এক প্রকারের ভেষজ উদ্ভিদ। গাছটির ভেষজ ব্যবহারের জন্য এর পাতা, লতা, মূল ও ফল ব্যবহৃত হয়।তেলাকুচা ফলে আছে 'মাস্ট সেল স্টেবিলাইজিং', 'এনাফাইলেকটিক-রোধী' এবং 'এন্টিহিস্টামিন' জাতীয় উপাদান। কবিরাজী চিকিৎসায় তেলাকুচা বেশ কিছু রোগে ব্যবহৃত হয়, যেমন- কুষ্ঠ, জ্বর, ডায়াবেটিস, শোথ (edema), হাঁপানি, ব্রংকাইটিস ও জন্ডিস। রক্ত আমাশয়, সাদা আমাশয় ও ছুলি মতো রোগে ব্যবহার করা হয়।
দুধ বৃদ্ধিতে সহায়ক: শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের জন্য তেলাকুচার কচি ফল উপকারী বলে মনে করা হয়।
প্রাকৃতিক ওষুধ: আয়ুর্বেদ ও হারবাল চিকিৎসায় তেলাকুচার ব্যবহার বহুকাল ধরে প্রচলিত।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: গবেষণায় দেখা গেছে, তেলাকুচা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।থায়ামিন কার্বহাইড্রেটকে গ্লুকোজে পরিণত করতে সাহায্য করে। বেঙ্গালোরের একদল ডাক্তার গবেষণা করে বের করেছেন, তেলাকুচা প্রাকৃতিক ইনসুলিন হিসেবে কাজ করে ডায়বেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। ডায়াবেটিস হলে তেলাকুচার কাণ্ড সমেত পাতা ছেঁচে রস তৈরি করে আধাকাপ পরিমাণ প্রতিদিন সকাল ও বিকালে খেতে হবে। তেলাকুচার পাতা রান্না করে খেলেও ডায়াবেটিস রোগে উপকার হয়।
পাকস্থলীর জন্য ভালো: এটি হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যা কমায়।এই শাক খেলে খাবারের রুচি বাড়ে ,পেটে সমস্যা এবং বদহজমের জন্য এই শাক খাওয়ার রেওয়াজ আছে। তেলাকুঁচোয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থায়ামিন থাকার কারণে এটি পরিপাক সহায়ক।
এটি প্রোটিন এবং চর্বি ভাঙতেও সহযোগিতা করে, স্থুলতা কমায়। এটি খেলে শরীরের অবসন্নতা কাটে, স্নায়ুতন্ত্র ভালো থাকে,পরিপাকক্রিয়া সহজ হয়, পরিপাকতন্ত্র ভালো থাকে, কিডনিতে পাথর সৃষ্টি হতে পারে না।
প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দিতে সাহায্য করে, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সাবধানতা
কারো কারো ক্ষেত্রে এলার্জি, শ্বাসকষ্ট ও প্রদাহের(inflammation) সৃষ্টি করতে পারে।
পাকা তেলাকুচার ফল ও পাখিদের আকর্ষণ
যখন তেলাকুচার ফল পেকে যায়, তখন এটি গাঢ় লাল রঙ ধারণ করে। এই সময় এটি বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দূর-দূরান্ত থেকে পাখিরা এসে এটি খেয়ে থাকে, যা পরিবেশের জন্যও উপকারী।
ভুল ধারণা দূর করা জরুরি
এতোদিন ধরে যে ফলটিকে ভয় পেতেন, সেটিই আসলে স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য উপাদান! সঠিক তথ্য না জানার কারণে আমরা অনেক সময় অমূলক ভয় বা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। তবে বিজ্ঞানের আলোয় আজ প্রমাণিত যে, তেলাকুচার ফল পাগল হওয়ার কারণ নয়, বরং এটি একটি উপকারী ভেষজ উপাদান।
তাই, ভুল ধারণা নয়-সঠিক উপায়ে ব্যবহার করে তেলাকুচার স্বাস্থ্যগুণ উপভোগ করুন!
সূত্র:https://tinyurl.com/3rheau7d
আফরোজা