আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক
বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের দেশজুড়ে তৈরি একের পর এক হাসপাতাল। অবকাঠামোগতভাবে যা বিশ্বমানের। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০ টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়। যেগুলোর বেশিরভাগই অবকাঠামোগতভাবে বিশ্বমানের। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে বিশাল জায়গাজুড়ে বানানো হয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালও। কিন্তু সেই তুলনায় রোগীদের আস্থা ফেরাতে চিকিৎসার মান বাড়াতে কোনো কাজই করা হয় নি। ফলে রোগীদের বিদেশমুখী চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর এর জন্য শুধু মেডিকেল ট্যুরিজমে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে, যার বেশিরভাগই ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, মেডিকেল ট্যুরিজম কেবল অন্য একটি দেশে সেবা নেওয়া নয়, এটি একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সক্ষমতা এবং দুর্বলতার প্রতিফলন। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া অর্থনৈতিক প্রভাব যতটা তীব্র, ততটাই উদ্বেগের। এ অবস্থায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনোয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেডিকেল হাব হিসেবে গড়ে তুলার দাবি জানিয়েছেন তারা।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) আয়োজিত ‘চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখীতা : আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, মেডিকেল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা পর্যটন বা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতের সেক্টরের ব্যর্থতা প্রকাশ করে। মেডিকেল ট্যুরিজম যদিও প্রাচীন গ্রীসের নিরাময় মন্দির এবং রোমান সাম্রাজ্যের খনিজসমৃদ্ধ পানিতে গোসল থেকে শুরু হয়েছে। আজ চিকিৎসা পর্যটন হলো একটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ব্যবসা। যা অর্থনীতিকে পুনর্র্নিমাণ করে এবং স্বাস্থ্যসেবাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে। ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো পাওয়ার হাউস হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা পশ্চিমা খরচের ভগ্নাংশে অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রদান করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫ লাখ ডলার খরচ হতে পারে এমন একটি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ভারতে মাত্র ৫০ হাজার ডলারে করা যায়। এই একটি উদাহরণেই যথেষ্ট কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা সেবার জন্য অন্য দেশে যায়।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মেডিকেল ট্যুরিজমের শিকারে পরিণত হয়েছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক অভিজাত শ্রেণীর লোক চিকিৎসার জন্য বাইরে যেত। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়া জোয়ারে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। এটা নিছক পরিসংখ্যান নয়; বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত নাগরিকদের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু তাল মিলাতে পারছে তার ইঙ্গিত দেয়।
ধনী ব্যক্তিরা হয়তো সিঙ্গাপুরের চকচকে হাসপাতাল বা থাইল্যান্ডের মেডিকেল স্পা-এ যেতে পারেন, কিন্তু সিংহভাগ ভারতেই যায়। অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসা পর্যটকরা ভারতীয় হাসপাতালে যান, তাদের সান্নিধ্য, সামর্থ্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের খ্যাতির কারণে।
এই চিকিৎসার জন্য বিদেশে গমনের অর্থনৈতিক প্রভাব যতটা তীব্র, ততটাই উদ্বেগের। বাংলাদেশ প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারায়, যার বেশিরভাগই ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করে। এই অর্থপ্রবাহ কেবল একটি আর্থিক বিষয় নয় এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সমস্যা, যা দেশে উন্নত সুযোগ-সুবিধার অভাব থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার মতো ঘাটতিগুলোকে সামনে আনে।
কিন্তু নাগরিকরা যখন উন্নত চিকিৎসার আশায় অহরহ দেশের বাইরে যায়, তখন দেশটির স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এটা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মূল কাঠামো ভেঙে পড়ছে বুঝায়। দেশের বাইরে রোগীদের এই ক্রমাগত প্রবাহ শুধু সিস্টেমের ঘাটতির প্রতিফলন নয়, বরং উপর্যপরি স্থানীয় সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগগুলোর অপচয়ের একটি কঠিন বাস্তবতা।
প্রতিবছর বিদেশে ব্যয় করা বিলিয়ন ডলারগুলো যদি দেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে পুনঃবিনিয়োগ করা যেত, তবে আমাদের অর্থনীতিতে এর নানামুখী সুফল পাওয়া যেত বলে মত দেন তারা।
এর সমাধান তুলে ধরে আলোচকরা বলেন, মেডিকেল ট্যুরিজমের গল্প, বিশেষত বাংলাদেশ থেকে বিদেশমুখী রোগীর প্রবাহ যেমন সমালোচনা, তেমনই এটি একটি কর্মপ্রেরণার আহ্বান। এটি আত্মবিশ্লেষণ ও যুতসই সমাধানের দাবি রাখে।
চ্যালেঞ্জটি বিশাল, কিন্তু এর মধ্যেই সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে আছে-শুধু একটি সংস্কারকৃত নতুন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নয়, বরং এমন একটি পুনর্গঠিত জাতীয় পরিচয়ের জন্য। যা সব নাগরিকের মঙ্গল ও সমতার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়। এমন একটি বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারি, যেখানে বিশ্বমানের হাসপাতালগুলো সারাদেশে বিস্তৃত থাকবে, যা শুধু দেশের নাগরিকদেরই নয়, বরং বাইরের রোগীদেরও আকৃষ্ট করছে। এটি কোনো অবাস্তব স্বপ্ন নয়, বরং একটি বাস্তব সম্ভাবনা, যা সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল।
এ লক্ষ্যে সরকারের উচিত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোখাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া। যা সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা জায়ান্টদের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা এই অগ্রগতিকে দ্রুততর করতে পারে, যা নিয়ে আসবে দক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয়।
স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে তার চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং মেধা ধরে রাখতে শক্তিশালী প্রণোদনা ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। যাতে মেধাবীরা দেশে ফিরে আসে অত্যাধুনিক সুবিধা এবং পেশাগত সন্তুষ্টি ও প্রতিযোগিতামূলক বেতনের আকর্ষণে বিদেশে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি ডাক্তাররা দেশে ফিরে এসে কাজ করেন। দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে মোকাবিলা করার জন্য স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা এই প্রচেষ্টাগুলোর ভিত্তি হতে হবে।
আর কে