ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ন্যাচারোপ্যাথি

ঐন্দ্রিলা আক্তার 

প্রকাশিত: ১২:০৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১২:২৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ন্যাচারোপ্যাথি

বর্তমান সময়ের সংক্রামিত অসুখগুলোর মধ্যে চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুজজ্বর অন্যতম। এতে আক্রান্ত রোগী প্রায় সব ঘরে ঘরে রয়েছে। এই দুই ধরনের জ্বরেই মানুষ আক্রান্ত হয় এডিস মশা কামড়ালে। তবে, চিকুনগুনিয়া জ্বর জীবনঘাতী না হলেও ডেঙ্গুজ¦র কিন্তু মানুষের মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা করার পাশাপাশি উভয়ের মধ্যকার সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য তুলে ধরব, যা থেকে সাধারণ মানুষ সচেতন এবং সঠিক প্রতিকার এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

চিকুনগুনিয়া

চিকুনগুনিয়া জ্বর একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। ভাইরাসটি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নামে পরিচিত। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত মানুষকে এডিস মশা কামড়ালে মশা এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সেই মশা মানুষকে কামড়ালে মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। চিকুনগুনিয়া মরণঘাতী না হলেও মানুষকে এমনভাবে আক্রান্ত করে যে, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা, জ্বর ভালো হয়ে গেলেও আক্রান্ত ব্যক্তি পরবর্তী দীর্ঘদিন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। এতে করে ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক এবং আর্থিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রোগ লক্ষণ প্রকাশের সময়
সাধারণত মশা কামড় দেওয়ার দুই থেকে বারো দিনের মধ্যে শরীরে চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। লক্ষণ-
* মাত্রাতিরিক্ত জ্বর। জ¦রের কারণে শরীরের তাপমাত্রা ০২ থেকে ০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। 
* জ্বর শুরু হয় প্রচন্ড শরীর ব্যথা নিয়ে। বিশেষ করে মেরুদণ্ড এবং শরীরের সকল জয়েন্টগুলোতে অসহনীয় ব্যথা হতে থাকে।
* চোখের প্রদাহ হয়।
* বমি ভাব।
* মাথাব্যথা।
* পেটে ব্যথা এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
* শরীরে হামের মতো লাল লাল ফুঁসকুড়ি দেখা দেয়।
* শরীরে অস্বাভাবিক চুলকানি দেখা দেয়। বিশেষ করে পেটে, হাতে, পায়ে, পিঠে। চুলকাতে চুলকাতে আক্রান্ত স্থান বা ত্বক কালচে রং ধারণ করে এবং খসখসে হয়ে যায়।
* জ্বর দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে গেলেও ব্যথা ভালো হয় না। বরং ব্যথার কষ্ট চলতে থাকে সপ্তাহ, মাস কখনো কখনো বছরব্যাপী।
* এই ব্যথা শরীরের সমস্ত ছোট এবং বড় জয়েন্টগুলোতে হতে থাকে। যেমন-
- আঙুলের জয়েন্টগুলোতে অসহ্য ব্যথা থাকে, যার কারণে হাত মুঠো করতে কষ্ট হয়।
- কাঁধে এমন ব্যথা হয় যে, কখনো কখনো হাত নড়াচড়া পর্যন্ত করা যায় না। এমনকি বিছানায় এক পাশ থেকে অন্য পাশে ফিরে শোয়া যায় না।
- হাতে কষ্টকর ঝিমঝিম অনুভূতিসহ টনটনে ব্যথা হয়।
- হাঁটু ব্যথা এমন হয় যে ওঠাবসা করা যায় না।
- পায়ের গোঁড়ালি এবং পায়ের পাতায় টনটনে ব্যথার কারণে হাঁটতে এমনকি জুতা পরতেও কষ্ট হয়।
- তীব্র ব্যথার কারণে কোনো কোনো জয়েন্টে প্রদাহ হয়ে ফুলে যায়।
* শরীর খুব ক্লান্ত লাগে।
* মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
* রোগের দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় চুল পড়তে থাকে।
জয়েন্টের ব্যথা এব মাসপেশির দুর্বলতার কারণে শরীর নড়াচড়া করতে ভীষণ কষ্ট হয়। যেমন- বসলে সহজে ওঠা যায় না। আবার দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সহজে বসা যায় না। ব্যথার ধরন এবং স্থায়িত্বকাল এমন যে, তা আথ্রাইটিসে রূপ নেয়।

যেভাবে রোগের বিস্তার ঘটে 
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এডিস মশা মানুষকে কামড়ালে মশার লালার মাধ্যমে প্রথমে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে রক্ত এবং লসিকা নালীর মাধ্যমে শরীরে ভ্রমণ করে। এরপর শরীরের মাংসপেশি, জয়েন্ট, লিভার এমনকি মস্তিষ্ককেও কখনো কখনো আক্রান্ত করে ফেলে।
চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড় দিয়ে সেই মশা একজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তিও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই এই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে অসুস্থ ব্যক্তি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে মশারির নিচে রাখা উচিত।

চিকুনগুনিয়া হয় কখন 
সাধারণত বর্ষা ঋতুর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ শীতের শুরুতে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায় এবং চিকুনগুনিয়া জ¦র দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু ভাইরাস বা উঊঘঠ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়। মশা কামড় দেওয়ার চার থেকে দশ দিনের মধ্যে জ্বররসহ লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
- সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর  
- সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা ০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়।
- মাথাব্যথা।
- মাসপেশি, হাড় এবং জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা থাকে।
- চোখের পিছনে ব্যথা হয়।
- বমিভাব এবং বমি হতে পারে।
- শরীরে লাল লাল ফুঁসকুড়ি দেখা দেয়।
- রক্তে প্লাটিলেট এর মাত্রা কমে যেতে থাকে।
* রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু জ্বর
রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু জ্বরকে ডেঙ্গু শক্ সিনড্রোমও বলা হয়ে থাকে। যখন রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন এটা হয়।
রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির উপরের উপসর্গগুলো থাকে। তবে, এর মূল লক্ষণগুলো শুরু হয় জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার প্রথম বা দ্বিতীয় দিন থেকে। যেমন-
-    পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
-    অনবরত বমি হতে থাকা।
-    শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তপাত হতে থাকে। যেমন- মাড়ি থেকে, নাক দিয়ে, বমির সঙ্গে, পায়খানার সঙ্গে এমনকি পাকস্থলী এবং অন্ত্রের মতো অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোতেও রক্তপাত হয়ে থাকে।
-    চামড়ার নিচে রক্তপাত হয়।
-    শ্বাসকষ্ট
-    ক্লান্তি
-    অস্থিরতা
-    রক্তের উপাদান নিউট্রোফিল এবং প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যায়।
-    রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যায়।
-    রোগী ডেঙ্গু শকে আক্রান্ত হয়, যা মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে।
লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া মাত্র জরুরিভিত্তিতে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং জরুরি চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।

প্রতিকার এবং প্রতিরোধে করণীয় এসব ভাইরাসের নির্মূলে কোনো ওষুধ না থাকার কারণে চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে মূলত উপসর্গের চিকিৎসা পাওয়া যায়। তাই এসব ভাইরাস থেকে সংক্রমণের প্রতিকার এবং প্রতিরোধ হিসেবে সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকা। এর জন্য করণীয়গুলো হলো-
* যথাসম্ভব শরীরকে পর্যাপ্ত কাপড়ে ঢেকে রাখা। যেমন- ফুল স্লিভ পোশাক পড়া।
* শরীরের খোলা অংশে নারকেল তেল মেখে রাখা।
* ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা।
* বাড়ির আশপাশের খোলা জায়গা, গাছের টব ইত্যাদিতে পানি জমতে না দেওয়া।
* কিছুদিন পর পর বাড়ির আশপাশে এবং নালাগুলোতে মশা নিধক ওষুধ ছিটানো।
* বাড়ির আশপাশের ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার রাখা।

* বাসাকে অতিরিক্ত জিনিসপত্রে বোঝাই না করে খোলামেলা রাখা। কারণ, ঘিঞ্জি জায়গায় মশা লুকিয়ে থাকে।
* এছাড়াও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখা। যাতে করে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলেও শরীর কাবু না হয়ে পড়ে এব জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়তে পারে। এজন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং শরীর চর্চা করতে হবে।

আক্রান্ত হলে করণীয় 
* আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মশারীর নিচে থাকতে হবে, যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা আক্রান্ত না হয়। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড়ালে সে মশা আবার সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেও ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। 
* পর্যাপ্ত তরল পান করা।
* ডালিম, মালটা, কমলা, আমড়া, পেঁপেঁ, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, আমলকি, লেবু, নাসপাতি, আপেল, আনারস, ইত্যাদি ফল বা ফলের রস নিয়মিত খাওয়া।
* দেশি মুরগির স্যূপ, ডিম, দেশি মাছ, পালং শাক খেতে হবে।
* পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকতে হবে।
* রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী রাখতে এব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সচল রাখতে আকুপ্রেসার থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এসময় রোগিকে থেরাপি দিতে হবে।
* রোগী জ্বর মুক্ত হলে সপ্তাহে একদিন হিলি অয়েল দিয়ে ক্লিনিক্যাল ম্যাসাজ করাতে হবে। এতে করে শরীরের ব্যথা এব দুর্বলতা কাটতে থাকবে এব রক্ত চলাচল এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে।

উপকারি ভেষজসমূহ গুলঞ্চ পাতার রস, পেঁপে পাতার রস, গমের চারার রস, অশ্বগন্ধ্যা, আমলকী, মঞ্জিষ্ঠা, নিম পাতা, আদা, গোল মরিচ, কাঁচা হলুদ, তুলসী পাতা-এসব ভেষজসমূহ নিরাপদ ও প্রাকৃতিক এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক কষ্ট দূর করতে সাহায্য করে। ফলে রোগি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে অবশ্যই ন্যাচারোপ্যাথি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এসব ভেষজ খেতে হবে। কারণ, ব্যক্তিভেদে, বয়সভেদে ভেষজ গ্রহণের সময় এবং মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভুল সময় এবং ভুল মাত্রায় খেলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু জ্বর উভয়ই স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে অসুখগুলো প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে আক্রান্ত করছে এবং অনেকের প্রাণনাশের কারণও হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে গর্ভবতী মায়েরা। কারণ, মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

এছাড়াও বয়স্ক মানুষ, যাদের হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস রয়েছে তাদের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অসুখগুলো। 

অন্যদিকে, শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কথায় বলে, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’। কাজেই, আসুন সচেতন হই। নিজ বাড়ি, পাড়া, মহল্লা, অলিগলিকে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি। নিয়মিত ভালো খাবার খাই। শরীর চর্চা করি। সুস্থ থাকি।

লেখক : কনসালটেন্ট এন্ড ট্রেইনার অব ন্যাচারোপ্যাথি অ্যান্ড ইয়োগা

শিউলি/ এসআর

×