হাড় হলো একটি কঠিন অঙ্গ, যা মেরুদণ্ডি প্রাণীর কঙ্কাল তৈরি করে। হাড়গুলো দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে সুরক্ষা দেয়, লোহিত এবং শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে, খনিজ পদার্থ জমা রাখে, শরীরের কাঠামো তৈরি করে এবং চলনে সহায়তা করে। অস্টিও অর্থ হাড় এবং পরোসিস অর্থ পোরস বা ছিদ্র। অস্টিওপরোসিস বলতে বোঝায় যখন হাড়ে বেশি পরিমাণে ছিদ্র তৈরি হয়। হাড়ের দুটি অংশ থাকে। ওপরের শক্ত আবরণটিকে বলা হয় কমপ্যাক্ট বোন। ভেতরে স্পঞ্জের মতো ছিদ্র ছিদ্র করা স্তরটিকে বলা হয় স্পঞ্জি বোন বা ট্রেবিকুলার বোন। অস্টিওপরোসিস হলে হাড়ের ওপরের আবরণ বা কম্প্যাক্ট বোন অনেক পাতলা হয়ে যায় এবং স্পঞ্জি অংশটির ছিদ্র বেড়ে যায় বা ঘনত্ব কমে যায়, যা হাড়কে দুর্বল করে ফেলে। হাড় সাধারণত একদিকে ক্ষয় হতে থাকে আরেকদিকে গঠন হতে থাকে। যদি ক্ষয় হওয়ার গতি, নতুন হাড় গঠন হওয়ার গতির চাইতে কমে যায়, তখনই অস্টিওপরোসিস হয়।
পঞ্চাশোর্ধ্ব এক-তৃতীয়াংশ নারী ও এক-পঞ্চমাংশ পুরুষ অস্টিওপোরোসিসে ভোগেন। ৪০ বছর বয়সের আগে হাড়ের বৃদ্ধি বেশি হয়, ক্ষয় কম হয়। এরপর থেকে হাড়ের ক্ষয় বেশি হয়, বৃদ্ধি কম হয়।
হাড় ক্ষয় রোগের কারণ
১) বয়স বৃদ্ধি...যত বয়স বাড়ে তত হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়।
২) জেনেটিক- পরিবারে কারও অস্টিওপোরোসিস থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২) লিঙ্গ-মহিলাদের সাধারণত মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির কারণে হাড়ের দ্রুত ক্ষয় হয়।
৩) পুষ্টির অভাব-ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি হাড়ের গঠনকে দুর্বল করে।
৪) ব্যয়ামও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব।
৫) ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত কফি পান।
৬) হরমোনজনিত সমস্যা- থাইরয়েড ও প্যারাথাইরয়েডের রোগ, কুশিং সিনড্রোম ইত্যাদি।
৭) প্রদাহজনিত রোগ-রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গেটে বাত।
৮) ওষুধের কারণে স্ট্র্যারয়েড, খিচুনির ওষুধ, পেপটিক আলসারের ওষুধ - পিপিআই।
হাড় ক্ষয় রোগের লক্ষণ
হাড় ক্ষয় একটি নীরব ঘাতক। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাড় ভাঙ্গার পর রোগ নির্ণয় হয়।
১) উচ্চতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়া।
২) কোমর, পিঠ ও নিতম্বে ব্যথা।
৩) কুজো হয়ে যাওয়া।
৪) কোমর, হাতের কবজি, পায়ের কুচকির হাড়ের ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা বেশি যতটুকু আঘাতে একজন ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গার কথা তার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়।
যেভাবে শনাক্ত করা হয়
সাধারণ এক্স-রে দ্বারা অস্টিওপোরোসিস সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে। তবে সঠিকভাবে এর মাত্রা জানতে হলে বোন মিনারেল ডেনসিটি (বিএমডি) পরীক্ষা করা দরকার। সাধারণত কোমর, মেরুদণ্ড বা কব্জির ডেক্সা স্ক্যান করে বিএমডির সঠিক মাত্রা নির্ণয় করা হয়। বিএমডি দ্বারা হাড়ের ঘনত্ব সঠিকভাবে নির্ণয় করে হাড় ভাঙার ঝুঁকি এবং এর সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করা যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সুষম খাদ্য : ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ, দই, পনির), সবুজ শাকসবজি এবং ভিটামিন ডি-এর জন্য মাছ, ডিম খাওয়া।
ভিটামিন ডি গ্রহণ : নিয়মিত সূর্যালোক গ্রহণ করুন। প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫ মিনিট গায়ে রোদ লাগাতে হবে। প্রয়োজনে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিন। নিয়মিত পরিমাণমতো ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
নিয়মিত ব্যয়াম : ওজন বহনকারী ব্যয়াম যেমন হাঁটা, দৌড়ানো বা সাইক্লিং হাড় মজবুত করে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন : এগুলো হাড়ের ক্ষতি করে। কফি কম পান করা।
পিরিয়ডিক বোন ডেনসিটি টেস্ট : ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করে ঝুঁকি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
চিকিৎসা পদ্ধতি
ওষুধ : ১) ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম-ভিটামিন ডি প্রতিদিন ৮০০ থেকে এক হাজার ইউনিট, ক্যালসিয়াম প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০ মিলিগ্রাম খেতে হবে।
২) ডাক্তারের পরামর্শে আরও কিছু ওষুধ খেতে হবে এবং ফলোআপ করতে হবে।
হাড় না ভাঙ্গার প্রতিরোধ
১) স্বাভাবিক চলাফেরায় শক্ত জুতা বা কেডস ব্যবহার করতে হবে।
২) পড়ে যাওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে বাথরুম পরিষ্কার রাখতে হবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে যায় তাই বাথরুমে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কমোড পায়খানার পাশে হাতল লাগাতে হবে।
৩) বাসায় চলাচলের জায়গা পরিষ্কার ও পিচ্ছিলমুক্ত রাখতে হবে।
৪)) উঁচু-নিচু জায়গায় চলাচল থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫) সিঁড়িতে রেইল লাগাতে হবে।
৬) অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে কাজ করা বা অস্বাভাবিকভাবে শরীরকে বাঁকিয়ে কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭) বেশি দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরামদায়ক যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। পাবলিক যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে কোনো সাহায্যকারী থাকতে হবে।
৮) এ রোগে যারা আক্রান্ত হন তাদের কোনোভাবেই অতিরিক্ত ওজন বহন করা যাবে না।
সর্বশেষে
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনধারা পরিবর্তন করে এই রোগের ঝুঁকি কমানো যায়।
লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, আলোক হেলথকেয়ার ,মিরপুর-১০, ঢাকা।
হটলাইন: ১০৬৭২