নুহা-নাবা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) জোড়া লাগানো শিশু নুহা-নাবাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করাসহ সামগ্রিক চিকিৎসায় হাসপাতালের ব্যয় হয়েছে ৪০ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৮ টাকা। আর শিশু দুটির পরিবারের ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ টাকা। সব মিলে গত আড়াই বছরে শিশু দুটির চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে অর্ধকোটি টাকার বেশি।
হাসপাতালের ব্যয়ের মধ্যে দৈনিক ৩ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে ৭০৫ দিনের কেবিন ভাড়া রয়েছে ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এই হিসাব ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগ জোড়া শিশু নুহা-নাবার অস্ত্রোপচারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অগ্রিম নিয়েছে ১০ লাখ টাকা।
এ বছরের ৯ জানুয়ারি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নামে এই টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো সেই টাকা হিসাবে সমন্বয় করা হয়নি। ৬ লাখ ৩১ হাজার ৯৫৮ টাকা ব্যয় হয়েছে হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে শিশু দুটির জন্য নিউরোসার্জারি বিভাগের কেনা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বাবদ। আর বাকি ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে হাসপাতাল পরিচালক কার্যালয় থেকে। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। বাকি আছে দেড় লাখ টাকা। গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রাথমিকভাবে শিশু দুটির চিকিৎসায় হাসপাতালের এই ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত শিশু দুটির চিকিৎসা কেন্দ্র করে পরিবারের ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন নুহা-নাবার বাবা আলমগীর হোসেন।
তিনি বলেন, ভর্তির পর আমরা প্রথম আট মাস হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ছিলাম। তখন আমাদের পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পরে কেবিনে ছিলাম ২৩ মাস। এ সময়ে খরচ হয়েছে আরও পাঁচ লাখ টাকা। সব মিলে ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে নুহা-নাবা ও ওদের মায়ের খাবার হাসপাতাল থেকে দিত। সঙ্গে আমরা তিনজন ছিলাম।
আমি, আমার মা ও ছেলে। আমাদের তিনজনের তিন বেলা খাবার বাইরে থেকে কিনতে হতো। রোগীর পথ্য লাগত। শিশু দুটিকে হাসপাতাল থেকে যে দুধ দিত, তা দিয়ে হতো না। অতিরিক্ত দুধ কিনতে হতো। আনুষঙ্গিক আরও খরচ ছিল। সব মিলে এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার বেশি গেছে।
আড়াই বছরের বেশি সময়ে নুহা-নাবার চিকিৎসার ব্যয় সমন্বয় করতে গিয়ে উদ্বেগে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। এসব ব্যয়ের অর্থ কীভাবে ও কোথায় থেকে সংগ্রহ হবে, সে নিয়ে চিন্তিত তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বুধবার রাতেবলেন, রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেবিন ভাড়া ও ওষুধপত্র বাবদ যে খরচ, সেটা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটা নিয়ে চিন্তিত। আগের প্রশাসনের আর্থিক শৃঙ্খলা ঠিক করার চেষ্টা করছি, যাতে ভবিষ্যতে আগের প্রশাসনের কারণে আমাদের সমস্যায় পড়তে না হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন সম্পূর্ণ মৌখিকভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বলা হয়েছিল শিশু দুটির চিকিৎসার অর্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর দেবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন এই চিকিৎসার জন্য একটি টাকাও রেখে যায়নি। এখন তো সেই সরকারও নেই। কীভাবে এই ব্যয় সমন্বয় হবে এ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমরা।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এখন এ টাকা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিবর্তে চলমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কীভাবে চাইব? অথচ আমাদের প্রত্যেকটি খরচের হিসাব প্রশাসনকে দিতে হয়। তৎকালীন উপাচার্য চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ টাকা সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে দায়িত্বে অবহেলা করেছেন।
ব্যয়নির্বাহের কথা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর : ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ নুহা-নাবার অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার যাবতীয় খরচ তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহন করবেন। সে অনুযায়ী বিনামূল্যে চিকিৎসার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
২০২২ সালের ৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের ডিন ও নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এবং নুহা-নাবার অস্ত্রোপচার দলের প্রধান ডা. মোহাম্মদ হোসেন উপাচার্য বরাবর একটি আবেদন করেন। যাতে বলা হয়, নিউরোসার্জারি অন্তঃ বিভাগে ওয়ার্ড ৩/বি-এর এফএনপি-১০ নম্বর বিছানায় নুহা এবং নাবা নামের ১৬ দিন বয়সী জোড়া বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। বাচ্চার অভিভাবক খুব গরিব হওয়ায় চিকিৎসাব্যয় বহনে অপারগ। এমতাবস্থায় বাচ্চাদের সুচিকিৎসার নিমিত্তে ও অ্যাকাডেমিক উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপারেশন এবং অপারেশন-পরবর্তী খরচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করা প্রয়োজন। আবেদনে সার্বিক চিকিৎসা বিনা খরচে করার অনুরোধ জানানো হয়।
এমন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ১০ এপ্রিল উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কেস হিসেবে নেওয়ার অনুমোদন দেন। তিনি ওই আবেদনে লেখেন, উল্লিখিত জোড়া বাচ্চাদের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার অ্যাকাডেমিক কেস হিসেবে গণ্য করা হোক।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যয় নির্বাহ করার কথা ছিল। তখনকার উপাচার্যের উচিত ছিল চিকিৎসার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেই অর্থ সংগ্রহ করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। এখন এই প্রশাসন বিপদে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ছিল নুহা-নাবার। কিন্তু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনে আগামী শনি-রবিবার ছুটি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। সে অনুযায়ী আগামী রবিবার ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। জন্মের ১৪ দিনের মাথায় হাসপাতাল এসেছিল শিশু দুটি। এখন বয়স ৩১ মাস ২০ দিন। অর্থাৎ ৩১ মাস ছয় দিন এই হাসপাতালেই কেটেছে তাদের। জোড়া ছিল। আলাদা হয়েছে। এখন বাড়ি ফিরবে আলাদা দুটি শিশু হয়ে।
শহিদ