ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার চাবিকাঠি ‘টেলোমিয়ার’

ড. জাকিয়া বেগম

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ৯ জুলাই ২০২৪

বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার চাবিকাঠি ‘টেলোমিয়ার’

জীবদেহ কোষকলা দিয়ে তৈরি

জীবদেহ কোষকলা দিয়ে তৈরি। জীবের স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও প্রজননের জন্য বিভাজনের মাধ্যমে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি জীবদেহের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসের মধ্যে তন্তুর ন্যায় সূক্ষ্ম, লম্বা এবং পেঁচানো একটি কাঠামো থাকে যাকে ক্রোমোজম বলা হয়। আর এই ক্রোমোজমের মধ্যে থাকে প্রোটন এবং ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে ‘ডিএনএ’-এর অণু দিয়ে তৈরি ‘জিন’। একটি ক্রোমোজমের মধ্যে কয়েকশো হাজার ‘জিন’ থাকে।

ক্রোমোজমের অভ্যন্তরস্থ ‘জিন’ এবং ‘ডিএনএ’ নামের অণুগুলোর মধ্যেই মানুষসহ অন্যান্য জীবের বংশগত উপাদান সংরক্ষিত থাকে আর জিনগত নির্দেশাবলী ধারণ করা এই ‘জিন’ এবং ‘ডিএনএ’র মাধ্যমেই জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এগুলোই কোষ থেকে কোষে জিনগত তথ্যসমূহ বহন করে। 
‘জিন’ তথা ‘ডিএনএ’র ধারক প্রতিটি ক্রোমোজমের উভয় দিকে একেবারে শেষপ্রান্তে থাকে ‘টেলোমেয়ার’। সহজ থেকে জটিল সবধরনের জীবের জন্যই কোষকলা বিভাজনের ক্ষেত্রে ‘টেলোমেয়ার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ‘টেলোমেয়ার’ হচ্ছে বিশেষায়িত এবং পনুরাবৃত্তিমূলক ‘ডিএনএ’ অণুক্রমজনিত অঞ্চল যা ক্রোমোজোমগুলোকে আবদ্ধ করে রেখে ভঙ্গুরতা, জট বেঁধে যাওয়া বা ত্রুটিজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ফলে ক্রোমোজমস্থ ‘ডিএনএ’গুলো প্রগতিশীল অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং এগুলোর কার্যক্ষমতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অটুট থাকে।

প্রতিবার যখন কোনো কোষ বিভাজিত হয় তখন টেলোমিয়ারগুলো একটু একটু করে কাটা পড়তে থাকে। তবে কম বয়সে স্বাভাবিকভাবে যেসব কোষকলার বিভাজনজনিত কারণে টেলোমিয়ারগুলোর কর্তিত হওয়ার হার বেশি থাকে সেগুলোর ক্ষেত্রে ‘টেলোমেরাস’ নামক এক ধরনের ‘এনজাইম’ কাপড়ে তালি দেওয়ার মতো করে টেলোমিয়ারগুলোর কর্তিত অংশগুলোকে জোড়া লাগতে সাহায্য করে যাতে করে এগুলো পূর্বাবস্থার তুলনায় অতিরিক্ত ছোট হয়ে না যায় এবং পরবর্তীতে কোষের  স্বাভাবিক বিভাজন অক্ষুণœ থাকে।
তবে জীবদ্দশায় দীর্ঘদিন ধরে কোষের বিভাজন এবং ক্রোমোজমের প্রতিলিপি তৈরি হতে থাকায় ‘টেলোমেয়ার’গুলোর দৈর্ঘ্য অল্প অল্প করে হলেও ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে এসে এগুলো এতটাই ছোট হয়ে যায় যে কোষটি আর সফলভাবে বিভক্ত হতে পারে না এবং এর পরিণতিতে কোষটির মৃত্যু ঘটে। ফলে শরীর ও স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে, দুর্বলতা দেখা দিতে থাকে, মস্তিষ্কের প্রখরতা হ্রাস পায়, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে ইত্যাদি বার্ধক্যজনিত রোগ এসে ভর করে। আর এই কারণে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্যকে কোষকলার বয়স বৃদ্ধি তথা বার্ধক্যের সূচক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে শরীরের স্বাভাবিক বিপাকীয় প্রক্রিয়া বজায় রেখে শরীর সুস্থ রাখতে টেলোমিয়ারগুলো  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে বার্ধক্য ত্বরান্বিত হওয়া এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ারও একটা বিশেষ যোগসূত্র দেখা গেছে। কোন কারণে যদি টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য কমার হার স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায় তবে সেক্ষেত্রে অকাল বার্ধক্য দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

বিশেষ করে ফুসফুস এবং রক্ত-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যকলাপে সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে সঙ্গে আয়ুস্কাল হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়।
রক্তস্থ কোষকলার টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে মস্তিষ্কের আয়তন কম হওয়া এবং মস্তিষ্কের অভ্যন্তরস্থ শে^ত পদার্থের আয়তন কম হওয়ারও গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে।

শরীরের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা স্বাভাবিক রাখা, নতুন কিছু শেখা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, তথ্যসমূহ প্রক্রিয়াকরণ, শরীরের ভারসাম্যতা বজায় রাখা ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ রক্তের শে^তকণিকা বা ‘লিকোসাইটের ভূমিকা অপরিসীম। তাই গবেষকরা রক্তস্থ কোষকলার টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যকে ভবিষ্যৎ মানসিক স্বাস্থ্যেরও সূচক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। 
অধুনা কিছু কিছু গবেষণায় শে^তকণিকাস্থ কোষকলার টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে পরবর্তীতে ‘ডিমেনশিয়া’ (স্মৃতিভ্রমজনিত) এবং ‘আলঝাইমার্স’ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। পরিপাক অন্ত্রের ক্যান্সার, মাথা এবং গলার ক্যান্সারের সঙ্গেও টেলোমিয়ারের ক্ষুদ্রতার যোগসূত্র স্পষ্ট হয়ে ঊঠছে।
তবে আশার কথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য হ্রাস পাওয়ার হার কমিয়ে এনে বার্ধক্যকে বিলম্বিত করে তোলা এবং আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে তোলা সম্ভব বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য সঠিক পর্যায়ে ধরে রাখতে হলে ধূমপান ও মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম, মানসিক চাপ কমিয়ে আনা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
এছাড়াও স্বাস্থ্যসম্মত ওজন ধরে রাখতে হবে। এলক্ষ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে ক্যালরির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য তালিকায় অধিক পরিমাণে আঁশযুক্ত ও উদ্ভিজ্জ খাদ্য, সবুজ শাক-সব্জি, ফল বিশেষ করে টক ফল, ডাল ও সীমজাতীয় খাদ্য, দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ওমেগা-৩ ফ্যাটিএসিড সমৃদ্ধ খাদ্য, ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’যুক্ত খাদ্য, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, কফি, গ্রীন টি যুক্ত করতে হবে; লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস যথাসম্ভব পরিহার করে মাছ, সামুদ্রিক মাছ ও সামুদ্রিক শৈবালযুক্ত খাদ্য গ্রহণে অধিক মনোযোগী হতে হবে। তাছাড়া টেলোামেয়ারের সম্পূরক (সাপ্লিমেন্ট) হিসেবে কিছু কিছু ওষুধ ইতোমধ্যে বাজারজাত করা হয়েছে; প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে সেগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে।
বর্তমানে টেলোমিয়ার নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন টেলোমিয়ারের উন্নততর কোনো সম্পূরকের সাহায্যে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মানুষের পক্ষে বার্ধক্য ঠেকিয়ে রেখে দীর্ঘকাল যৌবন ধরে রাখা, মস্তিষ্কের তীক্ষèতা ও শারীরিক শক্তি ও উদ্যমতা বজায় রেখে দীর্ঘ জীবন লাভ করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। ততদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে কর্মঠ রেখে সুস্থ জীবনধারা চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক : মেডিকেল ফিজিসিস্ট এবং অধ্যাপক ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ, মোবাইল: ০১৯১১৩৬৪১০৩।

×