বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস আজ
ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট থেকে শুরু করে ব্যোনম্যারো প্রতিস্থাপন। জটিল সব রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি বেড়েছে আধুনিক চিকিৎসাসেবার আওতায় আসা রোগীর সংখ্যা। কিন্তু এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়ও। মানুষের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চিকিৎসাসেবার পেছনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার প্রথম ধাপেই যে বিষয়টি আসে তা হলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা।
বাড়ছে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যাও। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি মূলভিত্তির মধ্যে দক্ষ মানবসম্পদ অন্যতম। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রয়োজন সুস্থ জনশক্তি। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বর্তমান সরকারের অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন যেকোনো সময়ের চাইতে সবচেয়ে ভালো।
সফলভাবে মোকাবিলা করেছে মহামারি করোনা। কিন্তু উচ্চ চিকিৎসাব্যয়সহ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে এখনো সফলতা আশানুরূপ নয়। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ রবিবার বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’। ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার’ (মাই হেলথ, মাই রাইট) প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হতে যাওয়া দিবসটিতে মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার উপলব্ধি করা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দিবসটি উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ইউনিভার্সাল হেলথ সার্ভিস কভারেজ সূচক ২০১০ সালে ৪৭ থেকে ২০২১ সালে ৬২-তে উন্নীত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে মেডিক্যাল, ডাক্তার, নার্স এবং মিডওয়াইফদের গড় ঘনত্ব প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে ২৮.০৫ এ দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৫ সালের পর থেকে ৩০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হারের অনুপাত হ্রাস পেয়েছে ৬৮.৫ ভাগ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ২০০০ সালে প্রতি হাজারে ৮৪ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে ২০২১ সালে ২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ২০০০ সালে নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৪১ জন থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ১৭ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে নতুন এইচআইভি সংক্রমণ ২৫ শতাংশ এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ৬২শতাংশ কমেছে। স্বাস্থ্যের অধিকারের প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রতি সত্ত্বেও এই অঞ্চলের প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর কভারেজের অভাব রয়েছে। সরকার গুলোর স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ, যা স্বাস্থ্যের অধিকার এগিয়ে নেওয়া ভিত্তি হওয়া সত্ত্বেও এটি অত্যন্ত কম। যার ফলে চিকিৎসা ব্যয় বেশি হয়েছে। যার ফলে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন পরিবারের অনুপাত বাড়ছে।
২০১৫ সালের তুলনায় ২০২১ সালে এই অঞ্চলে যক্ষায় মৃত্যুর হার ৮.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চারটি প্রধান রোগ-হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যু হার এখন ২১.৬ ভাগ। এত উচ্চ হার অগ্রহণযোগ্য।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক পরিসংখ্যান বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ বছর বছর কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির পকেটের খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছেন রোগী নিজেই। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। তবে এই ধারা শুধু তিন বছরের নয়। এই প্রবণতা দুই দশকের বেশি সময়ের।
২০২২ সালের শেষ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়মূলক ব্যয়ের মধ্যে পড়ছেন, চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৫৪ মার্কিন ডলার। ১ ডলার ৮৪.৭৭ টাকা হিসাবে যা ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। ২০১৭ সালে তা ছিল ৩৭ মার্কিন ডলার এবং ২০১৪ সালে ছিল ৩৩ ডলার। বর্তমানে ব্যয় বাড়লেও তা শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের চেয়ে কম।
প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে দেশে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ব্যক্তি বা খানার ব্যয় ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ, সরকারের ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ। বাকি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর। মানুষ সবচেয়ে বেশি খরচ করেন ওষুধের পেছনে। ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ চলে যায় এই খাতে। বাকি অর্থ ব্যয় হয় রোগ নির্ণয় বা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা, চিকিৎসক দেখাতে, হাসপাতালে ভর্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা নিতে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ দিন দিন চিকিৎসা সেবা নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দিবসটি উপলক্ষে সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ সবার জন্য স্বাস্থ্যের অধিকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মানবাধিকার এগিয়ে নিতে ডাব্লিউএইচও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সবার জন্য স্বাস্থ্যের অধিকার উপলব্ধি করার অর্থ হল এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে প্রত্যেকে উচ্চমানের স্বাস্থ্য সুবিধা, পরিষেবা এবং পণ্যগুলোর সুযোগ গ্রহণ করতে পারে যা জনগণের চাহিদা, বোঝাপড়া এবং মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দেয়। এটি অধিকারের একটি সম্পূর্ণ সেটকে বোঝায় যা মানুষকে স্বাস্থ্যকরভাবে বাঁচতে সক্ষম করে। যেমন শিক্ষা, নিরাপদ পানি এবং খাদ্য, পুষ্টিকর খাদ্য, পর্যাপ্ত বাসস্থান, ভালো কর্মসংস্থান, পরিবেশগত অবস্থা এবং তথ্য-যা সুস্বাস্থ্যের অন্তর্নিহিত নির্ধারক। আঞ্চলিক পরিচালক জোর দিয়ে বলেন, স্বাস্থ্যের অধিকার পূরণের জন্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্তর্নিহিত নির্ধারক উভয়ই উপলব্ধ, প্রাপ্তিযোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং পর্যাপ্ত মানের হওয়া উচিত। তিনি বলেন, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য মান-অথবা স্বাস্থ্যের অধিকার বিশ্বব্যাপী এবং অঞ্চলে ‘হু’র মিশনের মূল বিষয়। এটা ডব্লিউএইচও এর গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আঞ্চলিক পরিচালক বলেন, তবে, অগ্রগতি সত্ত্বেও, ডব্লিউএইচও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সবার জন্য স্বাস্থ্যের অধিকারকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য আমাদের এখনো যথেষ্ট উপায় রয়েছে।
নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং একটি অগ্রাধিকার জনস্বাস্থ্য সমস্যা-ব্যাপক রয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী তাদের জীবনে অন্তত একবার অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। যেখানে গ্রামীণ ও অশিক্ষিত মহিলারা এবং সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের লোকরা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। অনেকে এখনো টিবি, এইচআইভি/এইডস, অক্ষমতা বা মানসিক অসুস্থতার মতো কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থার সঙ্গে কলঙ্কের সম্মুখীন হতে হয়। তারা তাদের লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, যৌন উন্মাদনা বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্যের শিকার হয়। তিনি বলেন, সবার জন্য ভালো মানের স্বাস্থ্য সেবা আরও সহজলভ্য, গ্রহণযোগ্য করা দরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সেমিনার আয়োজন, স্যুভেনির প্রকাশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদর্শনী, জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সড়ক দ্বীপ সজ্জিতকরণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য কার্যক্রম। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছরের জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়, ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এই সংগঠন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। এদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস বলে নির্ধারিত হয়। প্রতিবছর সংস্থাটি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যা বিশেষ করে সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় এ দিবসটি।
যেভাবে এল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছরের জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়।
১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এ সংগঠন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার দিনটিই বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস নির্ধারিত হয়। এদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় এ দিবসটি। প্রতিবছর সংস্থাটি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যা বিশেষ করে সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।