ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

দখল হয়েছে শতাধিক খাল, কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা 

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০৯:২৭, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

দখল হয়েছে শতাধিক খাল, কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা 

ছবি : সংগৃহীত

উপকূলীয় সাগরপারের কলাপাড়ায় খাল-নদী দখল চলছে ফ্রি-স্টাইলে। ছোটবড় অন্তত দুইশত খাল ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে নদী দখল। দখল করে তোলা হচ্ছে বসতবাড়ি, ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ দখল সন্ত্রাসের কারণে জনজীবনসহ কৃষিক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কৃষিজমির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে এক পশলা ভারি বৃষ্টিতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। আর শুকনো মৌসুমে ব্যবহারের কোন পানি থাকে না। খাল-নদী রক্ষায় উপজেলা ভূমি প্রশাসন থাকলেও তারা এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। উল্টো সরকারি খাল-বিল কিংবা খাস জমি দখলে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার তহশিলদাররা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ছে। মোট কথা খালবিল, নদী দখলে চলছে রাম রাজত্ব।

 

সরেজমিনে চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে খাল দখলের কারণে। যেসব খাল আবার কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজন পুনর্খনন করা ওইসব খাল উল্টো ভূমি অফিসের সার্ভেয়াররা ভরাট খালকে চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে স্বনামে-বেনামে দালালদের যোগসাজশে বন্দোবস্ত দিয়েছে। রক্ষা পায়নি পাঁচ-ছয় ফুট পানি রয়েছে এমন খাল। বর্তমানে শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র খাল দখলের মহোৎসব চলছে। ফলে উপকূলীয় কলাপাড়ায় কৃষি উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহতের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে শত শত একর তিন ফসলী জমি এক ফসলিতে পরিণত হয়েছে। কুয়াকাটা, লতাচাপলী, ধুলাসার, মিঠাগঞ্জ, লালুয়া ইউনিয়নে কৃষি উৎপাদনে এমন বৈপরিত্য অবস্থা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি জরীপে কলাপাড়ায় অন্তত ছোট-বড় দেড় হাজার খাল রয়েছে। এসব খাল দিয়ে কৃষি জমির পানি নিষ্কাশন করা হতো। এসব খাল ও খালের শাখা প্রশাখা বহু আগেই ভরাট করে দখল করে নেয়া হয়েছে। মূল খালও দখল হয়ে গেছে অন্তত দুই শত। কেউ বাড়িঘর কেউবা পুকুর, আবার কেউ দখল করে করেছে মাছের ঘের। 

 

ধুলাসার ইউনিয়নের কাছারিখালটি দীর্ঘ প্রায় ১০ কিলোমিটার। এখনও বর্ষা মৌসুমে মানুষকে সাতরিয়ে পার হতে হয়। তখন পানিতে টই-টুম্বুর এ খালটিতে শাপলা ফুটে বিচিত্র রুপ নেয়। আশপাশের অন্তত পাঁচ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কৃষি জমির পানি ওঠা-নামা করে খালটি দিয়ে। ধুলাসার ইউনিয়নের চাপলী বাজারের একটু পাশেই এ খালটির অবস্থান। খালটির শেষ দিকে বাঁধঘেষা কয়েকটি বসতিও রয়েছে। তাদের দাবি ১৯৮০ সালে তারা খালেরপাড়ে বসতি গেড়েছেন। পুরনো নারিকেল গাছ রয়েছে। আর তখন খালটির গভীরতা ছিল অন্তত কুড়ি ফুট। অথচ ৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় ওই খালকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে ভূমি অফিস ১৩ জনকে বন্দোবস্ত দিয়েছে। তারা এতোদিন চুপচাপ ছিলেন। বর্তমানে খালটি দখল করে বাড়িঘর ও পুকুর করা হয়েছে। সেখানকার জামাল শিকদার, শহীদ শিকদার খাল দখল করে এসব করছেন। এখালটি দখলের কারণে দুই পাড়ের জমির মালিক ও প্রান্তিক চাষীরা চরম উৎকন্ঠায় পড়েছেন চাষাবাদ নিয়ে। 

 

মিঠাগঞ্জের তেগাছিয়া বাজারের স্কুলের পাশের খালটিতে অন্তত ৩০টি বাঁধ দেয়া হয়েছে। একই দৃশ্য আজিমউদ্দিন-চরপাড়া স্লুইস খালের। এখালের আবার মানুষের বসতবাড়ি মিলিয়ে ছত্তার বয়াতী নামে একজনকে জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। গ্রামটির শতাধিক মানুষ এ অবৈধ দখলকাজ বন্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত প্রতিকার মেলেনি। 

নীলগঞ্জের টুঙ্গিবাড়িয়া, নীজকাটা, পাখিমারা, নবাবগঞ্জের একই হাল। টিয়াখালীর অন্তত ১০টি খালের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বাদুরতলীর সলুইস খালটি দখল করে সেখানে বাড়িঘর তোলা হয়েছে। সিকদারবাড়ি পয়েন্টে কালভার্টসহ বাঁধ দেওয়া হয়েছে। পানির প্রবহ আটকে দেওয়া হয়েছে। চাকামইয়ার তারিকাটার দীর্ঘ খালটিতে অন্তত ২৫টি বাঁধ দেয়া হয়েছে। ডালবুগঞ্জের খাপাড়া ভাঙ্গা গ্রামের এক কোরালিয়ার দীর্ঘ স্লুইস খালটিতে একটি মহল আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নিজের দখলে নিয়েছে। তারিকাটার দীর্ঘ খালটিতে অন্তত অর্ধশত পুকুর করা হয়েছে। মহিপুরের সুধিরপুর, মুলামের খালের একই দশা। চাকামইয়ার আনিপাড়ার দীর্ঘ খালটিতে বাঁধ আর দখল চলছে এক যুগ আগে থেকে।

 
প্রভাবশালীরা যা খুশি তাই করছে। এভাবে ফ্রি-স্টাইলে যে যার মতো খাল দখল করে চলছে। কিন্তু প্রত্যেকটি তহশিলের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তারা সরকারের এস্বার্থ রক্ষায় ন্যুনতম আন্তরিক নয়। উল্টো কোন সচেতন কৃষক কৃষিকাজের স্বার্থে তাদেরকে অবহিত করলে ধমক দেয়া হয়। কুয়াকাটার মাঝিবাড়ি এলাকায় জে এল নং ৩৪ এর লতাচাপলী মৌজার এক নং খাস খতিয়ানের এস এ ৪৭৫৬ ও ৪৭৫৭ দাগের একটি খাল ভরাট করে দেড় একর জমি দখল করে নবোদয় হাউজিং কোম্পানি তাদের প্রকল্পভুক্ত করে নেয় ২০০৪ সালে। ভূমি অফিসের সার্ভেয়াররা খাল ভরাটে বাধা দেয়নি। উল্টো তারা জমির ধরন পরিবর্তন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আজ পর্যন্ত ওই ভরাট খাল উদ্ধার করা হয়নি। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়াস্থ উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তথ্যানুসারে কলাপাড়ার গুরুত্বপুর্ণ ৮৮ টি খাল জরুরি ভিত্তিতে পুনর্খননের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছিলেন। ২০০১ সালের তথ্য এটি। পরবর্তীতে ২০১০ সালে তারা ৪৬টি খাল পুনর্খননের উদ্যোগ নেয়। এরপরে কিছু খাল পুনর্খনন করা হলেও মূল খাল উদ্ধার হয়নি। কারণ সীমানা নকসা অনুসারে নির্ধারণ না করেই খনন করা হয়েছে। দৃশ্যমান এ খালগুলো থাকলেও আরও অন্তত শতাধিক খাল কিংবা খালের শাখা দখল হয়ে গেছে। 

কুয়াকাটার প্রবীণ মানুষেরা জানান, পর্যটন এলাকায় কুয়াকাটার খাল, মাইটভাঙ্গার খাল, কাচারির খাল,  চাপলীর খাল, গোড়া খাল, বসুন খাল, খাজুরার খাল, নয়াপাড়ার খাল, কচ্ছপখালীর খালসহ অন্তত ৬০টি খাল এ ইউনিয়ন থেকে ভরাট করে দখল করে নেয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে সবাই বেশি দায়ী করছেন ভূমি প্রশাসনকে। কচ্ছপখালী ও নবীনপুরের খালটি তিন বছর আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয় কওে নামকাওয়াস্তে পুনর্খনন করলেও এখন যেই সেই অবস্থা। খাল খননে করা হয়েছে পুকুর চুরি। কুয়াকাটা পৌরবাসীর কোন কাজে আসেনি। খালকে কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া বেশি হয়েছে। 

সর্বশেষ ২০১১ সালের প্রথমদিকে সরকারিভাবে লতাচাপলী, চরচাপলী, কাউয়ারচর ও গঙ্গামতি মৌজার খাস জমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারি খাল রক্ষায় ও খাস জমি উদ্ধারে ওই নির্দেশনায় বেনামে ভূমিহীন সাজিয়ে বন্দোবস্ত কেসের খাস জমি উদ্ধারে পর্যটন এলাকার ত্রæটিপূর্ণ বন্দোবস্ত কেস শণাক্ত করতে গঠিত বিশেষ কমিটি  কাজ শুরু করে। ২০১১ সালে ভুমি মন্ত্রনালয়ের ৭ এপ্রিলের ২৬৯ নম্বর স্মারকে পটুয়াখালীর জেলাপ্রশাসক ৯ মে এক চিঠিতে এলক্ষ্যে তখন পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। যার প্রধান হলেন, অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহআলম সরদার। এছাড়া এই কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পটুয়াখালী, কলাপাড়া ভূমি অফিসের কানুনগো এবং এসএ শাখার সার্ভেয়ার। এছাড়া কলাপাড়ার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য সচিব করা হয়েছে। তখন শুধুমাত্র লতাচাপলী মৌজার ৮৮৮টি বন্দোবস্ত কেস শণাক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই কাজের অগ্রগতি রহস্যজনকভাবে থমকে আছে। বর্তমানে কলাপাড়ায় যেভাবে খাল দখল চলছে তাতে খাদ্যে উদ্ধৃত্ত এজনপদে কৃষিকাজে ব্যাপক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। কৃষি উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এবছরই আউশের আবাদ ভেস্তে যাচ্ছে।


কলাপাড়া উপজেলার ২০১১ সালের ল্যান্ডজোনিং রিপোর্ট অনুসারে উপজেলার লতাচাপলী এবং ধুলাসার ইউনিয়নে মোট জমির পরিমাণ ২৫ হাজার ২৭৩ একর। এর মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ ১৩ হাজার ৪৪১ একর। কী পরিমাণ কৃষি জমি কমে যাচ্ছে এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। শুধুমাত্র খাল দখল করে ভরাটের কারণে কৃষি জমি চাষাবাদের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে যে হারে খাল দখল করে বাড়িঘর কিংবা মাছের ঘের করা হয়েছে তাতে সাগরপারের এ জনপদে কৃষিকাজে মহাবিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। এমনিতে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। অপরদিকে কৃষি জমি চাষাবাদের খাল দখল ও ভরাট হয়ে কৃষি উৎপাদনে মহা বিপর্যয় নেমে আসছে। 


অভিজ্ঞ মহলের অভিমত ‘কৃষি জমি সুরক্ষা এবং ভূমি ব্যবহার আইনের’ যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী নইলে সাগরপারের এই জনপদে কৃষি উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে কৃষি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মতামত ব্যক্ত করেন। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যান্ড জোনিং কমিটির উপজেলা সভাপতি মো. রবিউল ইসলাম জানান,  গত বছরে খাল দখলমুক্ত করতে অন্তত ৫০টি খালের দেড় শতাধিক অবৈধ বাঁধ অপসারন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। কৃষি জমি রক্ষায় সরকারের নির্দেশনা অনুসারে এ কাজ চলছে।

মনিষা মিম

×