ছবি সংগৃহীত
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী এখন আর শান্তির জায়গা নয়। বরং এই জলাশয়ের পানি কাঁপানো রাক্ষুসে শিকারি মাছ সাকার মাউথ ক্যাটফিশের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে যাকে চ্যাক বাগা বা রোহিঙ্গা মাছ নামেও পরিচিত, তা এখন দেশের মৎস্য খাতের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশি মাছের শত্রু: সাকার মাউথ ক্যাটফিশ
আন্তর্জাতিকভাবে অ্যামাজন অববাহিকার বাসিন্দা এই মাছটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের জলাশয়ে। গবেষণায় উঠে এসেছে, মাছটি একদিকে যেমন বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের জন্য হুমকি, তেমনি অপরদিকে এটি দেশের মৎস্য খাতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে এমনকি পুকুরেও এখন এটি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। একসময় মাছ ধরার জন্য নামা জেলেরা আজকাল সাকার মাছের সঙ্গে জালের অন্য মাছের সন্ধানও পান না। ১০-১৫ কেজি সাকার মাছ উঠলেও তা বাজারে বিক্রি করা নিষিদ্ধ হওয়ায় জেলেরা সেই মাছ আবার নদীতে ফিরে ফেলতে বাধ্য হন।
গবেষকরা বলছেন, সাকার মাউথ ক্যাটফিশ খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং এটি প্রচুর খাবার খায়। এতে দেশি মাছের ডিম, লার্ভা খেয়ে ফেলতে পারে, যার কারণে অন্যান্য মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাছটির পাখনার ধারালো অংশও অন্য মাছের দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে, যার ফলে মাছগুলো পচে মারা যায়।
বাংলাদেশের মৎস্য খাতে হুমকি
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার মাছের অতিরিক্ত বৃদ্ধি দেশের মৎস্য খাতের জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র জানান, সাকার মাছ ইতোমধ্যে দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং পাওয়া গেছে পুকুরেও। সাকার মাছের সাথে অন্য মাছের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সাকার মাছের ক্ষতিকর প্রভাব
বিএফআরআইয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল আউয়াল বলেন, গবেষণায় পাওয়া গেছে, সাকার মাছের শরীরে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যাডমিয়াম রয়েছে, যা মাছটির খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী নয়। সাকার মাছ পানি ছাড়া ৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যা অন্য মাছের জন্য খুবই বিরল এবং বিস্ময়কর।
সমাধান বা সংকট?
২০২২ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সাকার মাছের আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে, এই নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে, কারণ এখন সাকার মাছ ধরা হলেও তা বিক্রি করা সম্ভব নয়। এতে মাছটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং জলাশয়ে তার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
অনেকে বলছেন, এই মাছের বিপণন নিষিদ্ধের পরিবর্তে সাকার মাছের পুষ্টিগুণ ও প্রজনন সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করা উচিত ছিল। বিশ্বের অনেক দেশেই এই মাছ মানুষের খাদ্য, প্রাণী খাদ্য, সার এবং কসমেটিক্স তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যদি বাংলাদেশেও সাকার মাছের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করা হতো, তবে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্পদ হতে পারত।
তবে, একদল গবেষক মনে করেন, সাকার মাছকে নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে, সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে এই মাছ সংগ্রহ করে তার চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, যা রপ্তানি করা সম্ভব। সাকার মাছের হাড় দিয়ে গাছের সার তৈরি করা যেতে পারে, যা কৃষি ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। এমনকি এটি প্রাণী খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
আশিক