ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

এবারও কী পাখি মারার উৎসব হবে?

সোহেল রানা

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৪:১৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

এবারও কী পাখি মারার উৎসব হবে?

ছবিটি একেঁছেন চিত্রশিল্পী আয়ুউব আল-আমিন।

‘ছোট পাখি ছোট পাখি, সর্বনাশ হয়ে গেছে। পৃথিবীর পরে আর, তোমার-আমার। ভালোবাসার কেউ নেই, কিছু নেই’। মৌসুমী ভৌমিকের এই গানটি মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতিতে পাখিরা কতটা অসহায়। বেঁচে থাকা তাদের কতটা কঠিন। আমাদের দেশে দিন দিন বিপন্ন হচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি-কীটপতঙ্গ। বাসস্থান হারাচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য পাখি। 

চলছে ডিসেম্বর মাস। এই মাসের শেষ সময়টা তাদের জন্য আতঙ্কের। থার্টিফাস্ট নাইটেই আতশবাজির ঝলকানি ও রঙিন আলোর ঝিলিক ছড়াবে দিগন্তপানে। এটা মানুষের জন্য আনন্দের বার্তা দিলেও পাখি ও কীটপতঙ্গের জন্য বেদনার্ত ব্যাপার। অসহায় তারা প্রকৃতিতে।

আমরা কী কখনো ভেবেছে? থার্টি ফাস্ট নাইট রাতকে কেন্দ্র করে অনেক পাখি-কীটপতঙ্গের জীবন দিতে হয়। প্রতিনিয়ত উচ্চ শব্দের কারণেও অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। এক তথ্যে জানা গেছে, সারা বিশ্বে থার্টি ফাস্ট নাইট পালন করতে গিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার কীট-পতঙ্গ ও পাখি প্রাণ হারায়। সংখ্যাটা বাংলাদেশেও কম নয়। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষবরণের রাতে শুধু ঢাকা শহরে চার প্রজাতির শতাধিকের বেশি পাখি মারা যায়। সে হিসেবে জেলা শহরগুলোতেও নানা প্রজাতির পাখি মারা যায়। বলতে গেলে, সারা দেশে প্রায় কয়েক হাজার পাখি মারা যায়- ওই রাতকে কেন্দ্র করে। পাখিদের কী অপরাধ? আমরা একটু সচেতন হলেই বাঁচাতে পারি নিরীহ পাখিদের।

পাখিটি উড়ার চেষ্টা করছে। ছবিটি নেওয়া হয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক ওয়াল থেকে।আতশবাজির বিকট শব্দ ও উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়। তাই বছরের অন্যান্য রাতের তুলনায় ইংরেজি নববর্ষের রাতে পাখিদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কয়েক হাজার গুণ বেশি। আতশবাজির তীব্র শব্দ ও আলোক ঝলকানির কারণে শত শত পাখিরা বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। এরপর অন্ধকারে বিভিন্ন বাসাবাড়ির জানালায় ও বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেয়ে মারা যায়। পাখির যোগাযোগের মাধ্যম শব্দ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে পাখি চলাচলের রাস্তা ভুলে যায়। পরে আর ফিরতে পারে না। উঁচু দেওয়ালের সঙ্গে আঘাত খেয়েও অনেক পাখি মারা যায়।

নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে মানুষের উৎসব-উদ্দীপনার শেষ থাকে না। এই উদযাপনের অন্যতম একটি অংশ আতশবাজি।  বিশেষ করে রাত সাড়ে ১১টার পর থেকে শুরু হয়ে যায় আতশবাজির তীব্রতা। চলে রাত ১টা পর্যন্ত। শব্দের এই বিভীষিকায় অসহায় হয়ে পড়ে পাখিরা। অসহায় হয়ে ছুটে চলে দিগদ্বিক। জ্ঞান শূন্য হয়ে চলতে গিয়ে দালানকোঠা ও গাছপালায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই বিভীষিকা থেকে বাঁচতে পাখি-কীটপতঙ্গ কার কাছে আর্তি জানাবে?

আতশবাজি হচ্ছে- নিম্নমাত্রার বিস্ফোরক। নান্দনিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে বহুল ব্যবহৃত এক ধরনের বাজি। মূলত আতশবাজির চারটি প্রাথমিক রূপ আছে, যথা: শব্দ, আলো, ধোঁয়া এবং ভাসমান উপকরণ। আতশবাজি লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি এবং সিলভার সহ নানান রঙের ঝলক সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী, খেলা এবং বহু সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার হয়। আতশবাজির প্রচলন চীন থেকেই শুরু। ১৭৮৬ সালে বার্থোলেট আবিষ্কার করেন আতশবাজি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও উৎসবের অনুষঙ্গ আতশবাজি। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি। ফলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দে পাখি বা কীটপতঙ্গ নয় শুধু, মানুষের জন্যও উচ্চ শব্দ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়! 

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষবরণের রাতে বেশ কিছু এলাকায় পাখিরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রাণ হারায়। বিকট শব্দে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় চড়ুই পাখির। এরপর কাক, বাতাসী ও ঘরবাতাসী পাখির মৃত্যুর খবর শোনা গেছে। উচ্চ শব্দের কারণে বাসা থেকে বেশি পালিয়েছে টিয়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খঞ্জন ও শালিক পাখি।

শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শহরের পাখিগুলো। রাজধানী বেশি পাখি মারা যায় মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানা, তেজগাঁও সাতরাস্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া, ওয়ারী ও সদরঘাট এলাকায়। 

টিয়ে পাখি।আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে আতশবাজির ভয়াবহতায় বলা হয়েছে, আতশবাজির কণাগুলো ধাতব লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়। এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।

বাংলাদেশে প্রতি বছর পুলিশের নানা বিধিনিষেধ থাকে থার্টি ফার্স্ট রাত ঘিরে। তারপরও রাজধানী ঢাকা-সহ সারাদেশের আকাশ আলোকিত হয় আতশবাজি আর ফানুসে। বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগা ও নানা দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। থার্টি র্ফাস্ট নাইটে যেসব আতশবাজি ব্যবহার করা হয়- সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট, লেড ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর কণা থাকে। যা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর, ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে পরিবেশবান্ধব আতশবাজির চল বাড়ছে। এমন কী কতক্ষণ আতশবাজি ফোটানো যাবে, সেই সময়ও বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতিবিষয়ক গবেষকরা বলছেন, আমাদের দেশেও এমনটা হওয়া উচিত

প্রজাপতিফ্রন্টিয়ারস ইন ইকোলজি অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, আতশবাজির বিকট শব্দ ও উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়। বছরের অন্যান্য রাতের তুলনায় থাটি ফাস্ট নাইট রাতে পাখিদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে থাকে বেশি। নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের রাডার এবং পাখির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি চালিয়েছেন। তারা আতশবাজি ফোটানো এলাকাগুলোর সঙ্গে নীরব বা শান্ত এলাকায় পাখিগুলোর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এতে তারা দেখতে পান, আতশবাজির শব্দ পাখিদের ওপর এক ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে। যা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে পাখিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। উৎসবগুলোর এমন আনন্দ যেন অন্য প্রাণীর ভয়, আতঙ্ক ও মৃত্যুর কারণ যেন না হয়।

আতশবাজির শব্দের কারণে পাখিদের মধ্যে বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। ফলে খাবারের সন্ধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয় পাখিদের। বিঘ্নিত হয় পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। পাখি নগরে যুদ্ধাবস্থা মনে করে অন্যত্র চলে যায়। তারা আর ফিরতে নাও পারে! পাখিরা না ফিরলে প্রাণপ্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। ফুল ও ফলে পরাগায়ণ হবে না। এতে উৎপাদন কমে যাবে। পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানাভাবে উপকার করে। পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব সকলের। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করার স্বার্থে সবাইকে বিধিনিষেধ মানতে হবে। পাখির সুরক্ষার প্রতি সকলকে দায়িত্বশীল ও যত্নবান হওয়ার কখা বলছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।

ছোট কীটপতঙ্গপ্রাণীবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ড.জগলুল হায়দার ইকবাল বলেন, আতশবাজি ব্যাপক হারে ফুটানো হলে অতিমাত্রায় শব্দ ও আলো সৃষ্টি হয়। পাখিরা আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাক করে, দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, বৈদ্যুতিক তারে আটকে মারা যায়। তারা না ফিরলে বা সংখ্যায় কমে গেলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলত: ফসল ও ফলের উৎপাদন লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পাবে। পাখির নিরাপদ ও বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আতজবাজি ফুটানোর শব্দের মাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবলের মধ্যে থাকে। যা মানুষের জন্যই অসহনীয়। সেখানে পাখিদের জন্য এই উচ্চ শব্দ আরও ভয়ঙ্কর। তা ছাড়া থার্টিফার্স্ট নাইটে রাত ১১টা থেকে ১টার মধ্যে শোরগোলের (নয়েজ) পরিমাণ বেড়েছে ১১৩ শতাংশ!  উৎসব উদযাপন প্রতিহত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। আতশবাজি ও পটকা বিক্রি বন্ধে এক মাস আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

পাখি। ছবি: ফটিকছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক ওয়াল থেকেইনাম আল হক একজন নিসর্গপ্রেমী মানুষ। এছাড়া তিনি পাখি-বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী ও সংগঠক। পাখি ও প্রকৃতি বিষয়ক সচেতনতা তৈরির প্রয়াসে গত কয়েক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এই পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, বাজি-বারুদে পাখির ক্ষতি হয়। বেঁচে থাকার জন্য পোকামাকড় থাকাটা জরুরি। সেটিই আমরা নানাভাবে নষ্ট করে ফেলছি। ৭০ শতাংশ পাখি পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। তাদের সুরক্ষা করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশবাদী সংগঠন শাইনের নির্বাহী পরিচালক মো. মুগনিউর রহমান মনি জানান, প্রকৃতিতে পাখি ও প্রাণী না থাকলে পৃথিবী মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে। মানুষ যদি প্রকৃতিতে না থাকে তাহলে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না। তবে পৃথিবীর বুকে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিতে পাখি ও প্রাণীর বেঁচে থাকার ব্যবস্থা মানুষকেই সুনিশ্চিত করতে হবে।

এসআর

×