ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

 জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে

মো: রফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৩ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ২১:৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

 জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে

এডিস মশা

বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। দেশের গবেষকেরা এর নাম দিয়েছে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু। বছর শেষ না হওয়ার আগেই গেল এক দশকের তুলনায় রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন মানুষের মধ্যে ভয় ও চিন্তার অন্যতম কারণ। ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সি যুবকেরা বেশি মারা গেছেন। গেল বছর দেশে মোট ৬২,০৯৮ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন। 

জানা যায়, বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তবে ডেঙ্গুর বড় সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল ২০১৯ সালে। সে বছরের সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার প্রায় অর্ধেকই ঢাকায়। আর ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল সারা দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৭ শতাংশ। দেশে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের অনেকগুলো প্রধান কারণ থাকলেও গবেষকেরা মনে করছেন জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম কারণ। এক ঋতু অন্য আরেক ঋতুতে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, সেইসঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে সাতটি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হওয়া দেশগুলোর তালিকায় আছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বলা হয়েছে, কোনো কোনো দেশে ডেঙ্গু জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ১৩টি কারণে সারা বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। 

১৩টি কারণে বিশ্বে ডেঙ্গু বাড়ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো এডিস মশা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মশার বসবাসের উপযোগী অন্যান্য কর্মকা- বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর উপযোগী আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, একই সঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনের বিস্তার, সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত করার সমস্যা, ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কোভিড-১৯সহ একই সময়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলা প্রাদুর্ভাব, ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি, ডেঙ্গু সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও আচরণ বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি, কমিউনিটিকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-ের ঘাটতি, মশার ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ঘাটতি, স্থায়ীভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অংশীজনদের কাজে সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচল।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ শতাংশ সাধারণ ও মারাত্মক ধরনের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভৌগলিক বিস্তার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা মশার প্রজনন ও রোগ বিস্তারের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে এবং করবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলো তিন লক্ষ ১৪ হাজার মানুষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে ১৬৩২ জন। শীত মৌসুম নভেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৪১ হাজার। 

ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক এক গবেষণায় জানিয়েছে, বাংলাদেশের ডেঙ্গু সংক্রমণের কারণ হিসেবে দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে সময়ের পার্থক্য তা মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ডেকে আনছে নতুন সব বিপদ। মৌসুম বা মৌসুম ছাড়াও ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে বিশেষ করে শহর এলাকায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে আছেন। গবেষকরা অনুমান করছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাহক মশার ভেক্টরিয়াল ক্যাপাসিটি বা রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে। একটি গবেষণা হুঁশিয়ারি প্রদান করেছে যে ম্যালেরিয়ার বাহক মশা সুপার পতঙ্গে রূপান্তরিত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি বা মহামারি নয় এর ভৌগোলিক বিস্তারও বাড়াবে। যেসব দেশে মশাবাহিত রোগ ছিল না সেইসব দেশেও রোগ বিস্তার ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীত প্রধান ইউরোপেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে যা ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজনন এবং এর মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের কিছু কিছু দেশে মশাবাহিত রোগ বিশেষ করে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে মশা বা মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদের সচেতনতার পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিবেশ সংস্থা এবং বৈশ্বিক নেতাদের কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। তা না হলে শুধু ডেঙ্গু প্রতিরোধ নয়, সামনে আমাদের আরো বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। দরকার হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষকদের নিয়ে কর্মশালা করে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। 

লেখক : মো: রফিকুল ইসলাম ,  সহ সম্পাদক,  দৈনিক জনকন্ঠ

শহিদ

×