ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতে জর্জরিত নতুন প্রজন্মের শিশুরা 

মিনহাজুর রহমান শিহাব 

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৯ জুলাই ২০২৪

জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতে জর্জরিত নতুন প্রজন্মের শিশুরা 

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের শিশুদের কোনো ভূমিকা না থাকার পরও শিশুদেরই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে।

পাঁচ বছরের শিশু সিফাত। যে বয়সে তার হাতে থাকার কথা ছিল কলম আর কাঁধে বইপুস্তকের ব্যাগ, সে বয়সে পরিবারের জন্য লাকড়ির সংস্থানে নুইয়ে পড়ে সময় কাটছে তার। অন্যদিকে চার বছরের পুতুলের দিনের সিংহভাগ সময় কাটে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত ঘরে প্রায় ৩০০ মিটার দূরের কল থেকে পানি আনার কাজে। এভাবেই দিনাতিপাত করতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশু সদস্যদের। 

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে করা এক গবেষণার জরিপে উঠে এসেছে এই চিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের শিশুদের কোনো ভূমিকা না থাকার পরও শিশুদেরই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদী ভাঙন, পাহাড় ধ্বস প্রভৃতি দূর্যোগে ঘর হারানো যে শিশুটি পরিবারের সঙ্গে নিজ বাসস্থান ও গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে টিকে থাকার আশায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা সে কখনো শোনেনি। কিন্তু স্বার্থপর জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে হারাতে হচ্ছে শৈশবের ছুটে বেড়ানো সময়, কৈশোরের দুরন্তপনা কিংবা তারুণ্যের প্রতিটি ক্ষণ। একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ভর করে বেড়ে উঠছে এই প্রজন্মের বেশিরভাগ শিশু। 

ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। গত দুই দশকে বাংলাদেশে প্রায় ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। আর জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আছে এ দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে জর্জরিত নতুন প্রজন্মের শিশুরা স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় আচরণ, দক্ষতা ও স্মৃতিশক্তিতে পিছিয়ে, পুষ্টিহীনতায় ভোগে তাদের পরিপূর্ণ দৈহিক ও মানসিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়। জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যায় শিশুদের অভিযোজন সক্ষমতা বড়দের তুলনায় কম এবং ঝুঁকি থাকে বেশি। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের অপুষ্টিতে ভোগা, ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি থাকে। স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে, দারিদ্র্য ও স্থায়ী আবাসস্থল না থাকায় এই প্রজন্মের লাখ লাখ শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, কেউবা স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে আবার কঠিন কাজে যুক্ত হচ্ছে। এতে একটি অদক্ষ শ্রমবাজার গড়ে উঠছে, যার কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশ। এতে একদিকে যেমন দারিদ্র্যতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না, অন্যদিকে ভাগ্য উন্নয়ন ব্যর্থ হচ্ছে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। আর মেয়ে শিশুদের অনেক পরিবার দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এতে শারীরিক নানা জটিলতায় মেয়ে শিশুদের সুস্থ জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে। এই শিশুরা যদি ঠিকমতো পড়াশোনার সুযোগ এবং স্বাভাবিক জীবন পেত, তাহলে তাদের বিকাশ আরও উন্নত হতো। 

প্রায় চার দশক আগে সন্দ্বীপ থেকে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে আসা মো. রফিকের পরিবারের আশ্রয় হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ১নং ওয়ার্ডের সন্দ্বীপ কলোনিতে। অসহায় পিতা সেই সময় জীবনযুদ্ধে পরিবার নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়ে দারিদ্র্যতার যাতাকলে সন্তানদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে অসমর্থ হন। ফলে শিক্ষার আলো ও নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত মো. রফিক বর্তমানে নিজ সাংসারিক জীবনেও সেই অভাবগ্রস্থতা ও দৈন্যতার চক্রে নিমজ্জিত। দিনমজুরের কাজে জীবিকার চেষ্টা চালালেও ভাগ্য যেদিন সুপ্রসন্ন হয় কেবল সেদিন কাজ জুটে, নতুবা পথ চেয়ে দিন কাটে বলে জানান তিনি। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রতীয়মান। 
 
জলবায়ু উদ্বাস্তু শিশুরা পারিবারিক অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে শহরাঞ্চলে এসে একদিকে যেমন নানাবিধ ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়ে শিশুশ্রমে পরিগনিত হচ্ছে। অন্যদিকে পথভ্রষ্ট হয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছে। প্রতিটি সংকট সমস্যায় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনেও তেমনি ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সামাজিক সমস্যাগুলো যেভাবে গুরুতর হচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয় আলাদা করে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থারও উচিত জলবায়ু উদ্বাস্তু নতুন প্রজন্মের শিশুদের সুরক্ষায় সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন ও ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি। সমাজের মূলধারায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের মৌলিক অধিকারটুকু বাস্তবায়ন জরুরি। সেই সাথে জলবায়ু সহিষ্ণু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে কম সৌভাগ্যবান পীড়িত এই মানুষদের ভাগ্য উন্নয়ন অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যাতে নতুন করে পরিবেশগত কোনো সংকট তৈরি না হয়, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস না হয় সেদিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

লেখক: গবেষক ও শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

এম হাসান

×