জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন ২০২২
বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নের নতুন রোডম্যাপ দাবি করেছে। সেই সঙ্গে তারা জোড়ার কণ্ঠে দাবি করেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ জলবায়ু অর্থায়ন দ্বিগুন করতে হবে। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো এ দাবি করে।
এবছর আগেই অনুমান করা হয়েছিল, এবারের ১৭তম জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নের আলোচনা বেশ উত্তাপ ছড়াবে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এবার আটঘাট বেধেই সম্মেলনে এসেছে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য। কারণ, বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও উন্নত দেশগুলো সবুজ জলবায়ু তহবিলে কোনো অর্থ প্রদান করছে না। মহামারি করোনার কারণে দ্বিপাক্ষিত অর্থায়নও সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। বিশেষ করে গত জলবায়ু সম্মেলনে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েও উন্নত দেশগুলো কোনো অর্থই প্রদান করেনি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা অনেকটা মুখথুবড়ে পড়েছে। এই অবস্থায় এবারের সম্মেলনে অর্থায়ন ইস্যু বড় হয়ে উঠবে আগেই আশা করা হয়েছিল। বাস্তবেও তাই হয়েছে।
আলোচনার শুরুতেই নেগোসিয়েশনের টেবিলে অর্থ নিয়ে আলোচনা বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তবে উন্নত দেশগুলো এবারও অর্থ প্রদান না করার জন্য নানা ফন্দি ফিকির করছে। তারা এবার অর্থ না দেবার জন্য নতুন কৌশল হিসাবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশিক মন্দাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
উন্নত দেশগুলো বলছে, বৈশ্বিক মন্দার কারেণে তাদের কাছে কোনো অর্থ নেই। ফলে তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য আগামী বছর কোনো অর্থ দিতে পারবে না।
নেগোসিয়েশনের টেবিলে আলোচনার পাশাপাশি সাইড লাইন ইভেন্টগুলোতেও উন্নত দেশের প্রতিনিধিরা তাদের এই বার্তা পৌছে দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়কত দূত জন কেরিও কয়েকটি সাইড লাইন আলোচনায় অংশ নিয়ে জলবায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উদ্দেশ্যে বলছেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে উন্নত দেশগুলোই এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে। তাদের কাছে কোনো অর্থ নেই। ফলে মন্দা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তণ মোকাবিলায় কোনো অর্থ প্রদান করা সম্ভব নয়।
তবে উন্নত দেশগুলোর এই বার্তায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো হতাশ নয়। এটি যে তাদের নতুন কৌশল তা তারা বুঝতে পারছে। তাছাড়া খোদ আয়োজক দেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জলবায়ু আলোচনার অন্যতম এজেন্ডা হিসাবে অর্থায়ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এই আলোচনায় বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতি বছর যথাক্রমে ৪ ট্রিলিয়ন ও ৭ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যা বর্তমান অর্থায়নের চেয়ে যোজন যোজন বেশি। তাই অর্থায়নের এই ফারাক দূর করার জন্য সব পক্ষের জোড়াল আলোচনা দরকার।
এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলার জন্য নতুন রোডম্যাপ দাবি করে। তারা এই দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে বলে, আগে অর্থায়নের যে পরিমাণ হিসাব করা হয়ছিল, বর্তমান বাস্তবতার আলোকে তা অনেক কম। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় ২০১৯ সালে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল, ২০২৫ সালে তা দ্বিগুন করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো কোন বছর কোন খাতে অর্থায়নের জন্য কী পরিমান অর্থায়ণ করবে তা ওই রোডম্যাপে উল্লেখ থাকবে। বিশেষ করে, জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে অর্থ প্রদানে উন্নত দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ঋণ প্রাপ্তির খরচ কমানোর দাবি তুলেছে। সেই সঙ্গে সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করতে বলেছে।
উন্নত দেশগুলো অবশ্য আলোচনায় অর্থায়নের নতুন উৎস খোঁজার তাগিদ দিয়েছে। তারা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেূ সীমাবদ্ধ রাখতে হলে যে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন তা কেবলমাত্র বেসরকারি খাতই যোগান দিতে পারে। এজন্য তারা অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে বলছে। একই সঙ্গে জলবাযু অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বহাপাক্ষিক অর্থায়নকারী সংস্থাকে যুক্ত করার কথা উল্লেখ করেছে।
আলোচনায় সবুজ কৃষি ও বন ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এটি করতে পারলে প্রতি বছর এই দুই খাত থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে যোগ হবে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হবে।
এ প্রসঙ্গে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে যোগদানরত তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে যে পরিমাণ অর্থ জমার পড়ার কথা ছিল সেটি এখনও জমা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমিয়ে আনতে সেই অর্থ সমবণ্টনের কথা ছিল, কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি যেভাবে সমাধান করার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। এসব বিষষ নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
তথ্যমন্ত্রী ও পরিবেশবিদ ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের অসহায় শিকার, প্রতিবছর এই সম্মেলনে বাংলাদেশ-সহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আমরা বহু বছর থেকে বলে আসছি, আমাদের প্রতিশ্রুত সাহায্য করতে হবে। এবারের সম্মেলনে পৃথিবীর বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা অংশগ্রহণ করছেন, যেটি প্যারিসে, কোপেনহেগেনে হয়েছিল, কিন্তু গত কয়েকটি কপে হয়নি। এটি আশার কথা।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ না হলে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা বাড়তে থাকবে। চলমান কপ সম্মেলনে ক্রমবর্ধমান অভিযোজন চাহিদা সমাধানের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক নির্গমণ হ্রাসের তাগিদ দিচ্ছি আমরা।
মন্ত্রী আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করতে হবে যাতে জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজনের মধ্যে ৫০:৫০ ভারসাম্য থাকে। অভিযোজন অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলে তা বাংলাদেশসহ দুর্বল দেশগুলির অভিযোজন চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
মন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলিকে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী প্রশমন প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে হবে এবং উন্নত দেশগুলি বিশেষ করে জি-২০ দেশগুলিকেও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
এমএইচ