বনে হরিণের বিচরন
সুন্দরবনে ভাইরাস ও রোগ জীবানু নির্ণয়ের বন্যপ্রাণীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দেশ-বিদেশী পর্যটকদের সংস্পর্শে আসা বন্যপ্রাণীর শরীরে ভাইরাস ও রোগ জীবানু রয়েছে কি-না, তা পরীক্ষা করতে ‘সুফল প্রকল্প’র অধিনে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ একটি মেডিকেল টিম নমুনা সংগ্রহ করছে। সুন্দরবনে প্রজনন কেন্দ্রটি সৃষ্টির গত ২০ বছরে এই প্রথম বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র ও পর্যটক ষ্পটগুলোতে খাচায় সংরক্ষিত এবং উম্মুক্তভাবে চলাচল করা বন্যপ্রাণীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছেন তারা।
সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো শুক্রবার বিকেলে (২১ অক্টোবর) জনকণ্ঠকে বলেন, বন অধিদপ্তর কতৃক বাস্তবায়নাধীন ‘সুফল প্রকল্প’ এর আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশেষত: বানরের মধ্যে জিনোটিক ডিজিস (প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামক রোগ) এর জীবানু শনাক্তকরণ ও এ সংক্রান্ত গবেষণার অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন বন্যপ্রাণী থেকে রক্ত, লালাসহ বেশ কিছু নমূনা সংগ্রহ করা হচ্ছে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য। এরই অংশ হিসেবে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র থেকে বানর ও হরিণের নমূনা সংগ্রহ করেছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ।
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণীর শরীরে যদি কোনো ঘাতক ভাইরাস থাকে, তা পর্যটকদের দেহে ছড়িয়ে পরতে পারে এমন সন্দেহে বন্যপ্রাণীদের পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এমন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বন বিভাগের সন্দেহ সঠিক হলে প্রয়োজনে সুন্দরবনের সকল বন্যপ্রাণীদের পরীক্ষা ও চিকিৎসার আওতায় আনা হবে।
বন বিভাগের বেটানারী সার্জন ও বন্যপ্রাণী রোগ নির্ণয় গবেষক ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ও বন বিভাগের ‘সুফল প্রকল্পের’ সরকারী গবেষণা কর্মকর্তা ডা. রচিউল হাসান বলেন, বন্যপ্রাণীদের বহণকরা করোনা ভাইরাস, বার্ডফ্লু, নিপা ভাইরাস ও টিবিসহ বেশ কিছু বড় বড় রোগের ভাইরাস বা জিবানু বহণ করতে পারে বন্যপ্রাণী। এ ধরণের বন্যপ্রাণীর সংস্পর্সে আসলে মানবদেহ আক্রান্ত হতে পারে।
বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আর নয়নাভিরাম সৌন্দার্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশী পর্যটকরা ভ্রমণে এসে বনের সুন্দরী বন্যপ্রাণীদের দেখলেই একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় অনেকেই। কেউ বন্যপ্রাণীর কাছে গিয়ে ছবি তুলে আবার কেউ ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের নিয়ে নিজ হাতে খাবার খাওয়াতে পছন্দ করেন। তবে অনেকেই জানে না এ বন্যপ্রাণীদের শরীরে বহন করতে পারে মরণ ঘাতক বিভিন্ন রোগের ভাইরাস ও জিবানু। তাই বন বিভাগের গ্রহণ করা ‘সুফল নামের প্রকল্পের’ মাধ্যমে দেশে যতগুলো বন্যপ্রাণীর অভায়রণ্য, প্রজনন কেন্দ্র বা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংরক্ষনকরা বন্যপ্রাণী রয়েছে। সে সকল প্রাণীদের শরীর থেকে রোগ বা রোগের ভাইরাস নির্নয় করার জন্য রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। অন্যান্য জায়গার ন্যায় গেল সপ্তাহে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র থেকে এই প্রথম সরাসরি মানুষের সংষ্পর্সে আসা ১০টি হরিণ ও ১০টি বানরের রক্তের নমুনা নেয় ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম। চলতি বছরের জানুয়ারীতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ চলবে আগামী ২০২৩ সালে জুন পর্যন্ত। পর্যাক্রমে সকল প্রাণীর রক্তের নমুনা সংগ্র করে পরীক্ষা করা হবে।
নিরীক্ষক টিমের সদস্যরা জানান, দেশের বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী অভায়রণ্য রয়েছে। যেমন- কেশপপুর হনুমানের অভায়রণ্য, মৌলভী বাজার শিপ পাঞ্জি ও উল্লুক’র অভায়রণ্য, মাদারীপুর বানর ও গাজীপুর সাফারী পার্কসহ যে সকল জায়গায় বন্যপ্রাণী বসবাস করছে, সেখান থেকে ওই সকল প্রাণীর শরীর থেকে রক্তের নমুনা নেয়া হবে। তবে সুন্দরবনে সরকারী প্রজনন কেন্দ্রটির স্থাপিত হওয়ার পর এই প্রথম বন্যপ্রাণীদের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ গবেষণার ফল আগামী নভেম্বর শেষের দিকে প্রকাশ হবে।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় এখানে প্রতিদিন শত শত দেশ-বিদেশী পর্যটক সুন্দরবনে ভ্রমনে আসেন। কেউ কেউ বন্যপ্রাণীর সংস্পর্সে যায়। তাই এমন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছে বন বিভাগ।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রেটি সরকারী ভারে চালু হয়। সে সময় থেকে অদ্যবদি পর্যন্ত অনেক পর্যটকদের কুমির ও বানরে কামড়ে আহত হয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদের বন বিভাগের পক্ষ থেকে আহত ব্যাক্তিকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষুধ দেওয়া হয়েছে। তারা পরবর্তীতে কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হননি। এছাড়া সংরক্ষণ করা বা উম্মুক্ত অবস্থায় রাখা বন্যপ্রাণীদের শরীরে এখন পর্যন্ত কোনো রোগ বা ভাইরাসের সন্ধানও পাওয়া যায়নি। আর বন্যপ্রাণীদের সংস্পর্শে আসা কোনো পর্যটকের রোগ বা ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি। তার পরেও নিশ্চিন্ত থাকতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এ উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বিলুপ্ত প্রজাতির বন্যপ্রাণী প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধি জন্য ২০০২ সালে সরকারীভাবে পূর্ব সুন্দরবনের করমজলে দেশের একমাত্র বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। যেখানে ১৯৫টি কুমির, ৯৬টি হরিণ ছাড়াও উম্মুক্তভাবে সহাস্রাধিক বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এটি মূলত হরিণ, কুমির ও কচ্ছপের প্রজনন কেন্দ্র বলে পরিচিত।
এমএইচ