কপ-২৭ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে নাগরিক সমাজ
জাতিসংঘের আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে এজেন্ডা হিসেবে ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে বাংলাদেশকে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজ প্রতিনিধিবৃন্দ।
বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমা ১.৫ ডিগ্রিতে রাখার লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তির আওতায় শূণ্য কার্বন নির্গমন বিষয়ে একটি আইনি বাধ্যবাধকতাসমৃদ্ধ প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে জোরালো ভূমিকা রাখা।
কোস্ট ফাউন্ডেশন, এন অর্গানাইজেশন ফর সোশিও-ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (এওএসইডি), সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি), কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি), সেন্টার ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুড (সিএসআরএল), ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ যৌথভাবে ‘কপ-২৭: সরকারি অবস্থান এবং নাগরিক সমাজের মতামত’ শীর্ষক এই সেমিনারে আয়োজন করে এবং এটি সঞ্চালনা করেন ইক্যুইটিবিডি-এর রেজাউল করিম চৌধুরী।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি। তিনি বলেন, রামপাল এলাকার তিনটি গ্রামে খাবার পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। সেখানে গভীর নলকূপ খনন করলেও খাবার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে অনেক অঞ্চলের এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে সরকার থেকে ৯৬১ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেশে দক্ষ জনবল তৈরি করতে কারিগরি শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আরো পড়ুন : তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রির বেশি হলেই অনলাইনে ঘৃণামূলক বার্তা বাড়ে
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এমপি (সাতক্ষীরা-২) এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আলী আকবর টিপু। এছাড়াও এতে আরও বক্তৃতা করেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদ শরীফ জামিল, সিপিআরডির মোঃ শামসুদ্দোহা, এওএসইডি-খুলনার জনাব শামীম আরেফিন, সিএসআরএলের জিয়াউল হক মুক্তা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এম আহসানুল ওয়াহেদ, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের শিরিন সুলতানা লিরা, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের আফসারি বেগম এবং আবুল বাশার। ইক্যুইটিবিডি থেকে সৈয়দ আমিনুল হক সেমিনারের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
আমিনুল হক বলেন, কপ ৭ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উন্নত দেশগুলি তাদের পূর্ববর্তী সমস্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করার চেষ্টা করছে এবং প্যারিস চুক্তির মূল নীতিগুলি এড়িয়ে যেতে চাইছে। তারা ‘নেট জিরো’ বা শূণ্য নির্গমন, নতুন সমষ্টিগত এবং পরিমাণকৃত লক্ষ্যের মতো নতুন ধারণাগুলোকে অর্থায়নের চেয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর প্রস্তাবিত এসব ধারণা প্রকৃতপক্ষে অসার এবং অস্পষ্ট। তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার যে কথা প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছে তার সঙ্গে এসব ধারণা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি নতুন আর্থিক ধারণা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোতে বার বার যে ক্ষয়-ক্ষতিগুলো হচ্ছে তার আলোকে একটি বাস্তব এবং কর্মমুখী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা ধনী দেশগুলোর প্রস্তাবিত নতুন এই আর্থিক নীতিতে নেই।
সেমিনার থেকে সরকারি প্রতিনিধি দলের কাছে কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়:
(১) কপ ২৭ আলোচ্যসূচিতে ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোরালো অবস্থান নিন।
(২) ধনী দেশগুলিকে তথাকথিত ‘নেট জিরো’ ২০৫০ ধারণার পরিবর্তে এনডিসি-এর মাধ্যমে প্রকৃত শূণ্য লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ পূরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এই পরিকল্পনাটি তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার লক্ষ্য রেখে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(৩) জলবায়ু অর্থায়নের নতুন কাঠামো অবশ্যই অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোর জন্য ঋণ-বহির্ভূত অর্থায়ন হিসেবে হতে হবে। তার মানে এনসিকিউজি-তে অনুদানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারপর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছাড়সমৃদ্ধ অর্থায়ন।
শামসুদ্দোহা বলেন, অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট এসিসটেন্স (ওডিএ)-এর বাইরে এবং ঋণ-বহির্ভূত কাঠামোর আওতায় অভিযোজন অর্থায়ন বাড়ানোর জন্য সরকারকে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নের নামে ধনী দেশগুলো ঋণের ফাঁদ (জলবায়ু প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিতে ঋণ মওকুপ পদ্ধতি) তৈরি করেছে, বাংলাদেশকে তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।
আসন্ন জলবায়ু সম্মেলন এবং এর আলোচনার প্রক্রিয়া অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোর চাহিদা অর্জনের জন্য জটিল একটি প্রক্রিয়া হবে, কারণ উন্নত দেশগুলি আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে এবং তাদের এজেন্ডাকে ভারসাম্যহীন উপায়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের সরকারকে তাদের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং সময়মতো আওয়াজ তুলতে অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোর জোটকে সংগঠিত করতে হবে।
শরীফ জামিল বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে জিরো নিঃসরণ নিশ্চিত করা ছাড়া বাংলাদেশের এই বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, তাই সরকারকে ‘নেট জিরো’ ধারণার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। প্যারিস চুক্তির আওতায় কোনো প্রেটোকল স্বাক্ষর করার আগে আলোচকদের কৌশলী হতে হবে যাতে দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ আদায় করা যায়।
জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা এবং তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, এছাড়াও অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও একাধিক জলবায়ু সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে। এগুলি মোকাবেলা করা প্রয়োজন জলবায়ু সম্মেলনে ইউএনএফসিসিসির অধীনে জলবায়ু তাড়িত বাস্তুচ্যুতির জন্য একটি পৃথক ব্যবস্থার দাবি করতে হবে।
মোস্তাক আহমেদ রবি এমপি বলেন, কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার এবং নাগরিক সমাজ উভয়েরই বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাপমাত্রার বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা এবং অভিযোজনের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের ব্যাপারে সবসময়ই সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন।
শামীম, রফিকুল ইসলাম এবং আরও অনেকে মনে করেন যে, সরকার এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে সু-সমন্বয় থাকায় বাংলাদেশ জলবায়ু আলোচনায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, এটি ছিলো আগে আমাদের একটি শক্তি, এখন সেটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কপ ২৭ এর জন্য নাগরিক সমাজের মতামত নিয়ে একটি অবস্থান গ্রহণের জন্য তাঁরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।