
জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন মানুষকে অনলাইনে ক্ষুদ্ধ করে তুলছে। দৈনিক তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রির বেশি হলেই অনলাইনে ঘৃণামূলক বার্তা বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক বা মৃদু উষ্ণ দিনের চেয়ে যা অধিকতর উষ্ণ দিনে ২২ শতাংশ বাড়তে দেখা গেছে।
এমনটাই জানা গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণার বরাতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা আজকের দুনিয়ায় এড়িয়ে চলার উপায় নেই। মানবসভ্যতার প্রতিটি কোণে পড়ছে যার ছাপ। এমনকি অনলাইনেও আমরা অনেক বেশি আগ্রাসী ও ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছি তার ফলে। এই গবেষণায় মানুষের মনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উঠে এসেছে।
এটি করেছেন জার্মান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত– পটসড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলেই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের কমেন্টে দেখা গেছে ঘৃণামূলক মন্তব্যের আধিক্য।
চলতি মাসে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে– ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নাল। সেখানে নিবন্ধের মূল লেখক আনিকা স্টেকিমেজার উল্লেখ করেছেন, 'উচ্চ তাপমাত্রার সাথে মানুষ কতোটা মানিয়ে চলতে পারে বা পারে না–আমাদের অনুসন্ধানের ফলাফল সেদিকে নির্দেশ করছে। তাপমাত্রা খুব উষ্ণ বা শীতল হলে আমরা দেখেছি অনলাইনে ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য বাড়ে; এক্ষেত্রে মন্তব্যদাতাদের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন'।
শিল্প-বিল্পব পূর্ব সময়ের চেয়ে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এখন ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ায় পৃথিবীজুড়ে আঘাত হানছে বৈরী আবহাওয়ার তাণ্ডব। কোথাও প্রচণ্ড খরা, কোথাওবা দেখা দিচ্ছে বন্যা। ইউরোপ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরের গ্রীষ্মে প্রাণ ওষ্ঠাগত করেছে চরম দাবদাহ।
গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, এই প্রচণ্ড গরমে বেড়েছে মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়া ও তার ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, আত্মহত্যা এবং পারিবারিক সহিংসতার হার।
বাস্তব জীবনের এ সকল ঘটনার সাথে সম্পর্ক রয়েছে মানুষের অনলাইনে আগ্রাসী আচরণের।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের মতে, সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষী পোস্টগুলিকে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা, তাদের অপদস্থ করাসহ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (গণহত্যাকে) উৎসাহিত করছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় এর ফলে 'ম্যাস শুটিং' এর মতো আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসও বাড়ছে।
গবেষণাটি করতে গিয়ে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মার্কিন ব্যবহারকারীদের ৪০০ কোটি টুইট বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এরমধ্যে তারা সাড়ে ৭ কোটি ঘৃণামূলক বার্তা শনাক্ত করেন, যা ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল।
জাতিসংঘের অনলাইন বিদ্বেষ এর সংজ্ঞার আওতায় রয়েছে, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-বিদ্বেষ এবং হোমোফোবিয়া-জনিত ঘৃণামূলক মন্তব্য। এই সংজ্ঞাই ছিল গবেষণায় বিদ্বেষ চিহ্নিতকরণের মানদণ্ড।
মানদণ্ড নির্ধারণের পর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হ্রাসের সাথে সাথে টুইট পোস্টের সংখ্যায় তার কী প্রতিফলন ঘটেছে- সেটি পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা।
গবেষকরা দেখেন, দৈনিক তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রির বেশি হলেই (স্থানীয়ভাবে সহনীয় মাত্রা) অনলাইনে ঘৃণামূলক বার্তা বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক বা মৃদু উষ্ণ দিনের চেয়ে যা অধিকতর উষ্ণ দিনে ২২ শতাংশ বাড়তে দেখা গেছে।
আর তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি হলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জলবায়ু জোনগুলির জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনলাইনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উত্তেজিত আচরণ বাড়তে দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মতো শুস্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ার অঞ্চলে সহনীয় মাত্রার চেয়ে তাপাঙ্ক ৪২-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ঘৃণামূলক পোস্ট বাড়তে দেখা গেছে ২৪ শতাংশ।
গবেষক দলটি ইউরোপেও একই বিষয় নিয়ে একটি গবেষণা করেন, যা গত বছর প্রকাশিত হয়। সেখানেও তারা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে অনলাইনে আগ্রাসী বার্তার যোগসূত্র খুঁজে পান।
আনিকা স্টেকিমেজার বলেছেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে- আমরা সবক্ষেত্রেই এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। (অর্থাৎ, শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়, প্রভাব পড়ছে শরীর, মন ও আচরণে)। তবে বেশিরভাগ জায়গাতেই এর সামাজিক পরিণতি নিয়ে খুব একটা খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে না। অথচ সামাজে সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে– এগুলি জানা ও বোঝার গুরুত্ব অপরিসীম'।
সূত্র: ব্লুমবার্গ