ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

গানের দর্শক কি কমছে?

আনন্দকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৯:৩০, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

গানের দর্শক কি কমছে?

জুলাই আন্দোলনের পর থেকেই ইউটিউবে বাংলা গান ও নাটকে সাড়া মিলছিল না। নাটক ছন্দে ফিরলেও এখনো গানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না দর্শক।  সরকার পতনের পর দেশ একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, বিনোদনের অপরাপর মাধ্যমও হয়েছে সরব, তবু ইউটিউবে গানে ফেরেনি দর্শক।
নতুন বছর উপলক্ষে ইমরান মাহমুদুল ফিচারিং আসিফ আকবরের ‘মন জানে’ গান প্রকাশিত হয়েছে ধ্রুব মিউজিক স্টেশনে। এর মধ্যে  কিছু দিন পার হলেও গানটি ভিউর দিক থেকে এখনো তিন লাখের ঘরে আসেনি। অথচ আসিফ আকবরের যে ফ্যানবেইস, ইমরানের যে ক্রেজ, তাতে এক সপ্তাহে অন্তত দুই মিলিয়ন মানুষের গানটি দেখার কথা।
বাংলা গানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান গায়ক-সুরকার-গীতিকার মুজা। বিশেষ করে হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে তার রসায়ন ভালো উপভোগ করেন দর্শক। দুই বছর আগে প্রকাশিত হওয়া এই জুটির ‘বেণী খুলে’ গানটি এর মধ্যে দেখা হয়েছে চার কোটি ১০ লাখের বেশি বার। প্রায় চার সপ্তাহ আগে এই জুটির নতুন গান ‘একলা দুনিয়া’ প্রকাশিত হয়েছে। গানটি ইউটিউবে দেখা হয়েছে মাত্র ২৩ লাখ বার!
একটা সময় আরফিন রুমি আর সাবরিনা পড়শির গান মানে ছিল হিট। এক সপ্তাহ আগে সিডি চয়েস থেকে এসেছে এই জুটির নতুন গানচিত্র ‘পরীর চেয়ে সুন্দর’। আরফিন রুমি নিজেই হয়েছেন মডেল। এক সপ্তাহে এটি দেখা হয়েছে মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার বার! পিছিয়ে পড়েছেন ভাইরাল শিল্পীরাও। গত বছরও তোসিবা বেগমের গান প্রকাশের পরপরই রাতারাতি দুই লাখ বা আড়াই লাখ ভিউ পেত। এই শিল্পীর ‘কালাচান’ সিরিজ তো রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। সেই তোসিবার জোয়ারটাও আর নেই। দুই সপ্তাহ আগে এই শিল্পীর ব্যয়বহুল গানচিত্র ‘নয়া বাতাস’ প্রকাশিত হয়েছে। আশানুরূপ সাড়া তো দূরের কথা, মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি মানুষ গানচিত্রটি দেখেছে। ভাইরাল ও আরমান আলিফ একটা সময় ছিলেন সমার্থক। তার গান এক সময় রাতারাতি মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পেত। তবে গত দুই বছরে সেই ধারাবাহিকতা একদম নেই। চার মাস আগে তার নতুন গান ‘ইট পাথরের শহর’ প্রকাশিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ লাখ মানুষ গানটি ইউটিউবে দেখেছেন। একইভাবে গগন শাকিব, শামজ ভাইরাও ভিউ হারিয়েছেন। এক কথায় বলতে গেলে, কোনো শিল্পীই আগের মতো ভিউ পাচ্ছেন না।
ইউটিউবে কেন বাংলাদেশী শিল্পীদের বাজার কমল সেটা নিয়ে কথা হলো জুয়েল মোর্শেদের সঙ্গে। ইউটিউব ও অনলাইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা এই কণ্ঠশিল্পী ও কম্পোজার বলেন, ‘বাংলাদেশে পাঁচ-ছয় মাস ধরে রাজনৈতিক নানা রদবদল চলছে। ফলে, মানুষ এখন গান বা নাটকের চেয়ে রাজনৈতিক কনটেন্ট দেখতে পছন্দ করে বেশি। আপনি দেখেন নিউজ চ্যানেলগুলোর সাবস্ক্রাইবার বেড়ে চলছে হু হু করে। কোনো কোনো  নিউজ ২৪ ঘণ্টায় দু-তিন মিলিয়ন হয়ে  যাচ্ছে, যেটা আগে গানের ক্ষেত্রে হতো। মানুষ আসলে বিনোদন থেকে আপাতত সরে গেছে। তবে এর মানে কিন্তু এটা না যে তারা ফিরবে না। আমি আশাবাদী। বিনোদন ছাড়া বাঁচতে পারে না মানুষ। আবার তাদের ফিরতে হবে গানে।’
একটা সময় নিয়মিত গান ও গানচিত্র প্রকাশ করত দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভি মিউজিক। এখন চ্যানেলটি থেকে শুধু নাটক ও নাটকের গানই প্রকাশিত হচ্ছে। সেগুলোরও আশানুরূপ সাড়া নেই। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহেদ আলী পাপ্পু বলেন, ‘সময়টা একটু টালমাটাল। তবে এটাও বিষয় হতো না। শিল্পীদের টিআরপি আমার মনে হয় ঠিক আছে। তবে প্রপার মার্কেটিংটা হচ্ছে না। এখন গান হিট করে টিকটক, ফেসবুকসহ আরও কিছু প্ল্যাটফরম থেকে। আমার প্রতিষ্ঠানে ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমের অভিজ্ঞরা কাজ করেন। আমার মনে হয়, তারকা শিল্পীরা যেখান থেকে গানগুলো প্রকাশ করছেন, সেখানে এই ধরনের এক্সপার্ট নেই। এখন তো বেশির ভাগ শিল্পী নিজেদের চ্যানেল খুলেছেন, কেউ কেউ আনকোরা ইউটিউব চ্যানেলে গান প্রকাশ করছেন। ফলে, অপেশাদারির জায়গাটা বেড়ে গেছে। আগে সাউন্ডটেক ছিল, সংগীতা ছিল, জি সিরিজ, অগ্নিবীণা, আমাদের সিএমভি আরও কত চ্যানেল ছিল! শিল্পীদের কাজ ছিল গান করে পারিশ্রমিক নিয়ে চলে যাওয়া। বাকি মার্কেটিং, প্রমোশন আমরা করতাম। ফলে, গানগুলোও বাজারে ছড়িয়ে পড়ত। এখন সেটা হচ্ছে না। আমার মনে হয়, শিল্পীদের আবার লেভেল কম্পানিগুলোর কাছে ফেরা উচিত। তা না হলে ভিউ আরও কমতে থাকবে।’
গত ছয়-সাত বছরে গানের  প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে ধ্রুব মিউজিক স্টেশন। তাদের প্রযোজনায় দেশের প্রথম সারির সব কণ্ঠশিল্পীই গান করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ধ্রুব গুহ নিজেও সংগীতশিল্পী। তার গাওয়া ‘যে পাখি ঘর বোঝে না’ এর মধ্যে ছয় কোটির মাইলফলকও পার করেছে। এখন কেন গানগুলো সাড়া ফেলছে না বা ইউটিউবে ভিউ পাচ্ছে না, তার কারণ নিজেও খোঁজার চেষ্টা করেছেন ধ্রুব। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমিও ছয় মাস ধরে বোঝার চেষ্টা করছি, মানুষ কেন গান শুনছে না। শেষ পর্যন্ত যে বিষয়গুলো উপলব্ধি করলাম, তার মধ্যে প্রথমটা হলো সময়। মানুষের এখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। একটা চাকরি করার পর অন্য কিছুও করতে হচ্ছে। শুধু গান কেন, নাটক-সিনেমা বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ারও সময় পাচ্ছে না সে। আরেকটি রাজনৈতিক ইস্যু। একের পর এক প্রেক্ষাপট চেঞ্জ হচ্ছে। মানুষ আছে থ্রিলারের মাঝে। কখন কী ঘটবে, সেসব নিয়েই ব্যস্ত। বিনোদন খোঁজার সময় কোথায়!’

×