রাজধানীর গানপ্রেমীদের জন্য দিনটি ছিল দারুণ আনন্দের।
রাজধানীর গানপ্রেমীদের জন্য দিনটি ছিল দারুণ আনন্দের। বিচিত্রি সুরের অবগাহনে কেটে গেছে তাদের দুরন্ত সময়। সুরেলা সেই সফরের শুরুটা হলো বিকেলে। শ্রোতাদের মুগ্ধতার আবেশে ভাসানো সংগীতাসরটির সমাপ্তি হয় রাতে। মাঝে কয়েক ঘন্টার সুরের স্রোতধারায় আবিষ্ট হলো মন-প্রাণ। সেই মুগ্ধতার অনুভবে কখনো বা শিল্পীর কণ্ঠের সমান্তরালে সুর মিলিয়েছেন। আবার কখনো উচ্ছ্বাসে জমিন থেকে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে নেচেছেন গানের তালে। এই গানের আসরে পরিবেশিত হয়েছে নানা ধারার গান। সেই সুবাদে বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী কনসার্টটিতে শ্রোতারা শুনতে পেয়েছেন দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে র্যাপ শিল্পীদের মনমাতানো গান। সেই সঙ্গে শোনা হয়েছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীতধারা কাওয়ালি থেকে বলিউডের সিনেমার গান। শনিবার আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই কনসার্টের শিরোনাম ছিল ‘ইকোস অব রেভল্যুশন’। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তার জন্য এই চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করে ‘স্পিরিটস অব জুলাই’ নামের প্লাটফর্ম। অভ্যুত্থানের প্রতিচ্ছবিময় এ কনসার্ট থেকে আয়কৃত অর্থ শহীদ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে অনুদান দেওয়া হবে।
মানবতার সেবায় নিবেদিত এ কনসাটের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন কিংবদন্তি পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অংশ নিয়েছেন এই সংগীতায়োজনে। এই শিল্পী যতক্ষণ গান গেয়েছেন শ্রোতারা তন্ময় হয়েছে শুনেছেন। কখনো বা উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হয়ে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছেন শরীরকে। রাহাত ফতেহ আলীকে অনুসরণ করে দেশের শিল্পীরাও স্বল্প পারিশ্রমিকে অংশ নিয়েছেন এই কনসার্টে। শ্রোতাদের মনমাতানো এই আয়োজনে অংশ নেয় দেশীয় ব্যান্ডদল আর্টসেল, চিরকুট, অ্যাশেজ ও আফটারম্যাথ। এছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন র্যাপ শিল্পী সেজান ও হান্নান। গান ছাড়াও জুলাই বিপ্লব-সংক্রান্ত গ্রাফিতি প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক ও মুগ্ধ ওয়াটার জোন কনসার্টে যুক্ত করে ভিন্ন মাত্রা।
দুপুর ২টায় দর্শকদের জন্য কনসার্টের ফটক খুলে দেওয়া হয়। এসময় জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম ঘোষণা দেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ১০০ জন কনসার্টের ভিআইপি আসনে সামনের সারিতে থাকবেন। রাত আটটার আগে ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধসহ জুলাই আন্দোলনে আহতদের নিয়ে আবারো মঞ্চে আসেন সারজিস আলম। এসময় স্নিগ্ধ সবাইকে নিয়ে ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ/শেষ হয়নি যুদ্ধ’ বলে স্লোাগান দেন। এসময় জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনাকে খুনি আখ্যা দিয়ে তার বিচার দাবি করেন। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করার দাবিও জানানো হয়।
পরিবেশনা পর্বের শুরুতে মঞ্চ মাতিয়েছেন আলোচিত দুই র্যাপার সেজান ও হান্নান৷ হান্নান শুনিয়েছেন অভ্যুত্থানের উদ্দীপনামূল সেই গান ‘আওয়াজ উডা’৷ এই গানটি গাওয়ার কারণে অভ্যুথানের সময় জেল খেটেছিলেন হান্নান। সেজান শুনিয়েছেন ‘কথা ক’ শীর্ষক সংগীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাওয়ালি গানের দল সিলসিলার পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় কনসার্ট। ব্যান্ডদল আফটারম্যাথ পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘হুংকার’, ‘ধোয়া ও ‘উৎসর্গ’। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ শীর্ষক গান দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে চিরকুট৷ এরপর ব্যান্ডদলটি একে একে গেয়ে শোনায় ‘জাদুর শহর’, ‘মরে যাবো’, ‘আহারে জীবন’ ‘কানামাছি'সহ বেশ কিছু গান৷
বর্তমানে কাওয়ালি আর সুফিগানে দুনিয়ার সেরা শিল্পী ধরা হয় রাহাত ফতেহ আলী খানকে। এই শিল্পীর পরিবারের রয়েছে ৫০০ বছরের কাওয়ালি চর্চার ঐতিহ্য। রাহাত ফতেহ আলী খানের বাবা ওস্তদাদ ফররুখ ফতেহ আলী খান, দাদা ফতেহ আলী খান, চাচা নুসরাত ফতেহ আলী খান। প্রত্যেকেই কালের সেরা শিল্পী। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে রাহাত তার চাচা ও বাবার সঙ্গে গাওয়া শুরু করেন। সর্বশেষ চাচা নুসরাত ফতেহ আলী খানের ছায়া থেকে বেরিয়ে তৈরি করেছেন নিজের আলাদা পরিচয়। সংগীতের ওপর অগাধ দখল ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রাহাত ফতেহ আলী খানকে দিয়েছে ‘ডক্টরেট অব মিউজিক’ এর বিশেষ সম্মাননা। তাকে মুসলিম সুফিদের ভক্তিমূলক গান ও কাওয়ালির কিংবদন্তি হিসেবেও অভিহিত করেছে অক্সফোর্ড।
১৯৯৭ সালে মাত্র ওস্তাাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান মারা যাওয়ার পর অল্প সময়েই কাওয়ালি আর সুফিগানের শিল্পী হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পান। দুনিয়াজুড়ে রয়েছে তাঁর গানের অসংখ্য শ্রোতা আর ভক্ত। ২০০৩ সালে ‘পাপ’ নামের বলিউডের একটি চলচ্চিত্রে ‘মন কি লগন’ গানটি করেন তিনি। এরপর গেয়েছেন অসংখ্য গান। পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার, আইফা, মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ডস, স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডসসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। কাওয়ালি ও গজলের পাশাপাশি বলিউড সিনেমায় প্লেব্যাক করার জন্য জনপ্রিয় রাহাত ফতেহ আলী খান। ‘পাপ’, ‘ওমকারা’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘লাভ আজকাল’, ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বাই’, ‘রেডি’, ‘বডিগার্ড’, ‘জান্নাত ২’, ‘হিরোইন’, ‘দাবাং’, ‘দাবাং ২’, ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো’সহ বলিউডের বহু ছবির গানে কণ্ঠ দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন রাহাত। তাঁর শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জরুরি থা’, ‘ও রে পিয়া’, ‘জগ সুনা সুনা লাগে’, ‘ তেরে বিন’, ‘তেরি ওর’, ‘ম্যায় যাঁহা রাহুঁ’, ‘তেরে মাস্ত মাস্ত দো ন্যায়ন’, ‘তুম যো আয়ে জিন্দেগি মে’, ‘দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি’ ইত্যাদি। কোক স্টুডিওতে তাঁর গাওয়া ‘আফরিন আফরিন’ ইউটিউবের বহুবার দেখা গানগুলোর একটি।
আর কে