ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস আজ

দেশের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যধারা সংরক্ষণে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০০:১৫, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

দেশের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যধারা সংরক্ষণে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস আজ

বিশ্বের অধিকাংশ দেশের রয়েছে নিজস্ব নৃত্যশৈলী। জনপ্রিয় নৃত্যধারার সমান্তরালে সেই নিজস্ব নাচগুলো টিকিয়ে রাখতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। দেওয়া হয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। তবে বাংলাদেশের নিজস্ব নাচকে বাঁচিয়ে রাখতে তেমন উদ্যোগ নেই বলে  আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এমন হতাশাকে সঙ্গী করে আজ মঙ্গলবার পালিত হবে আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস।  সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বর্ণিল আবহে বরণ করে নেওয়া হবে দিবসটি।

তবে দিবসটি পালনে এ উৎসবমুখরতার উল্টোপিঠে দৃশ্যমান হচ্ছে  দেশের নিজস্ব নৃত্যধারার দৈন্যদশা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধুঁকছে কিংবা হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলাদেশের নাচ হিসেবে পরিচিত নিজস্ব  বেশকিছু নৃত্যশৈলী। অবহেলিত হচ্ছে  বিয়ে থেকে শুরু করে উৎসব-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় রীতি কিংবা যাপিত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব নৃত্যধারা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝুমুর নাচ, ধামাইল নাচ,  মুখোশ নাচ, লাঠি নাচ, পদ্মার নাচন, গম্ভীরা নৃত্য, বাইদ্যার নাচ, বেহুলার লাচাড়ি, কালেক্টর নাচ, দ- নাচ, মাদার বাঁশের নাচ, কালী নাচ, পরী নাচ, ঘোড়া নাচ। এর মধ্যে ধামাইল ও লাঠি নাচ নিয়ে কিছু কাজ হলেও পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যার অভাবে  ধুঁকছে বাকিগুলো।

চর্চার অভাবে কিছু নাচ বিলুপ্তপ্রায়। এমনকি দেশজ নৃত্যের কোনো সরকারি তালিকা নেই। এমন বাস্তবতায় নৃত্যশিল্পী, সংগঠক ও গবেষকরা বলছেন, উদাসীনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে   দেশজ নাচগুলো। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যধারাসমূহকে রক্ষা করতে হবে। সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে গবেষণাধর্মী প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় শিল্পীদের কাছ থেকে নাচগুলো তুলে এনে সেগুলো নিয়ে উৎসব করার পাশাপাশি আর্কাইভ করতে হবে।

নইলে অচিরেই বিলুপ্ত হবে আপন সংস্কৃতির আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্যবহ এসব নৃত্যধারা। এমন বাস্তবতায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শিল্পকলা একাডেমি জানিয়েছে, আগামীতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।  যথাযথ উদ্যোগ  নিয়ে এগুলোকে বিলুপ্তির পথ থেকে বাঁচানো হবে।      
এ বিষয়ে শিল্পকলা পদকজয়ী নৃত্যশিল্পী, সংগঠক ও গবেষক লুবনা মারিয়াম জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত আমরা কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের সৃষ্ট সৃজনশীল বা আধুনিক নৃত্যচর্চা করে আসছি। পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যও এখানে জনপ্রিয়।  স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে এদেশের অনেক নৃত্যশিলী কত্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মনিপুরি নাচ শেখার সুযোগ পায়। এ সুযোগে তারা নাচগুলো রপ্ত করার পাশাপাশি নিখুঁত পরিবেশনার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন।

পরবর্তীতে তারা শিক্ষাপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নাচের স্কুলও খুলেছেন। শাস্ত্রীয় বা আধুনিক নাচ  নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে একজন শিল্পীকে অনেক কিছুই করতে হয়। কিন্তু এই ধারার নৃত্যচর্চার উল্টোদিকে বিস্মৃত ও অবহেলিত হতে থাকল বাংলাদেশের নিজস্ব নাচ। মুখোশ, গম্ভীরা, ধামাইল, ঝুমুর নাচ, পদ্মার নাচন, বেহুলার লাচাড়িসহ আমাদের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলোর প্রতি তখন আর কেউ নজর দিল না। ফলশ্রুতিতে এসব নৃত্যচর্চা থমকে যায়। এমনকি আমার নিজের নৃত্য সংগঠন সাধনাতেও আমি কত্থক, ভরতনাট্যমসহ শাস্ত্রীয় নাচ শেখালেও দেশজ নাচ শেখাতাম না। অথচ আমাদের এই নাচগুলো অনেক বেশি সুন্দর ও মাধুর্যময়।

একপর্যায়ে নিজের ভেতর দেশের নাচকে টিকিয়ে রাখার বোধটি জেগে উঠল। অতঃপর সাধনার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকনৃত্য শিল্পীদের সঙ্গে যোগযোগ শুরু করি। তাদের মাধ্যমে দু-একটি নাচ রপ্ত করে শিক্ষার্থীদের দেশজ নৃত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলি।  গত বছর কোরিয়াতে আমাদের দল  একটি মুখোশ নাচ পরিবেশন করে। সেটি দারুণভাবে দর্শকসমাদৃত হয়। কিন্তু  হঠাৎ করে এই একটি নাচের পরিবেশনার মাধ্যম দেশজ নৃত্যধারাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের নিজস্ব নাচকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণ করে এসব নাচ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকারি সহায়তা পেলে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা নিজস্ব নাচগুলো নিয়ে বিভিন্ন নৃত্যদল কাজ করতে পারবে। কিন্তু তেমনটা ঘটছে না। পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা বাংলাদেশের নাচগুলোর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। এই নাচগুলোর কোনো তালিকাও হয়নি সরকারিভাবে। এমনকি সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা যারা বংশপরম্পরায় এখনো নাচগুলোকে আগলে রেখেছেন তাদের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নেই মূল্যায়ন। নাচগুলো টিকিয়ে রাখতে কখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। তাই ঐতিহ্যবাহী অনেক নাচই এখন বিলুপ্তপ্রায়। এ অবস্থায়  এখনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে কোনোমতে টিকে থাকা নাচগুলো সংরক্ষণ করতে হলে স্থানীয় শিল্পীদের চিহ্নিত করতে হবে।  

গবেষকরা সেখানে থেকে নাচগুলোর সঙ্গে শিল্পীরা কিভাবে সম্পৃক্ত তা অনুসন্ধান করবে। তারপর সংশ্লিষ্ট তথ্যের ডকুমেন্ট করতে হবে। হাতের মুদ্রা, পোশাক, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারসহ সবকিছু আর্কাইভ করতে হবে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেসব নাচ নিয়ে  উৎসব আয়োজনসহ প্রদর্শনী করতে হবে। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামে বসবাস করা ৬৫ শতাংশ মানুষকে বিবেচনায় নিলেও ঐতিহ্যবাহী নাচের মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে শাস্ত্রীয় বা আধুনিক নাচের চেয়ে অনেক বেশি আবেদন রয়েছে লোকনৃত্যের প্রতি।   
অভিন্ন মত প্রকাশ করে একুশে পুরস্কারজয়ী নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা বলেন, আমাদের দেশের  নিজস্ব নাচগুলো অনেক সমৃদ্ধ। এগুলো লোকনৃত্যের আঙ্গিক হলেও জীবনধর্মী নাচ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। বিয়ে থেকে শুরু করে বাংলার উৎসব-পার্বণসহ ধর্মীয় রীতির নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে এসব নাচে। বিলুপ্তির পথে ধাবমান দেশজ নৃত্যগুলো নিয়ে আমার দল নৃত্যাঞ্চলও কাজ করছে। কিন্তু এসব নাচ মঞ্চে তুলে আনা খুব সহজ নয়। এসব নাচকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে তুলে আনতে হলে সেটা ব্যয়বহুল হয়ে যায়। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে গবেষণাও করতে হয়।

তাই চাইলেও বাংলাদেশের নিজস্ব নাচসমূহকে সংরক্ষণ বা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেটা সম্ভবও নয়।  এজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাচ নিয়ে কাজ হলেও বাংলাদেশের নিজস্ব নাচ নিয়ে  তেমন কাজ হচ্ছে না। তাই মন্ত্রণালয় যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে বা বিভিন্ন নৃত্যদলকে অঞ্চলনির্ভর নাচ তুলে আনার দায়িত্ব দিলে সুফল আসবে।

তখন সেই নাচগুলো নিয়ে বছরে কমপক্ষে দুটি উৎসব করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আপন ঐতিহ্যের স্মারক নাচগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।  নইলে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে হাঁটবে আমাদের নিজস্ব নৃত্যধারা।  এর মধ্যে ধামাইল ও লাঠি নাচ কোনোমতে টিকে থাকলেও বাকিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। 
জনপ্রিয় মণিপুরি নৃত্যশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের প্রভাষক ওয়ার্দা রিহাব বলেন, অবহেলা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলো  ক্রমশ বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তাদের বিলুপ্তপ্রায় নাচগুলো নিয়ে বছরজুড়ে গবেষণা হয়। সেসব নাচকে পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। এ জন্য দেশটির সংস্কৃতি খাতে পৃথক বরাদ্দ রয়েছে। উল্টোদিকে বাংলাদেশের নিজস্ব নাচ সংরক্ষণে কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় উদাসীন।

সে কারণে দেশজ নাচ সংরক্ষণে সরকারি পর্যায়ে যথাযথ কোনো উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পরিবেশনার জন্য আমাদের ডাকা হলেও ঐতিহ্যবাহী নাচ সংরক্ষণে খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পীদের কাছ থেকে কখনো কোনো পরামর্শ চাওয়া হয় না। আমাদের কখনো কাজে লাগানোরও চেষ্টা করা হয় না। কিছু নৃত্যদল নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করলেও সেটা দিয়ে বিলুপ্তপ্রায় নাচগুলোকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই সরকার উদ্যোগী না হলে একসময় বাংলাদেশের নিজস্ব নাচগুলো হারিয়ে যাবে।    
ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য সংরক্ষণের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের পরিচালক মেহজাবিন রহমান বলেন, এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিকষয়ক মন্ত্রণালয় আন্তরিক। আগামীতে শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে দেশজ নৃত্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। লোকনৃত্য  গবেষণা ও প্রশিক্ষণধর্মী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। সেখানে এসব নৃত্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের সম্পৃক্ত করা হবে। এজন্য পৃথক বরাদ্দ দরকার। তাই আশা করব, আগামীতে সংস্কৃতি খাতের বাজেটে লোকনৃত্য রক্ষায়  প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে।  তাহলে শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য সংরক্ষণে পদক্ষেপ  নেওয়া সহজ হবে।       
প্রসঙ্গত, ফরাসি নৃত্যশিল্পী আধুনিক ব্যালে নৃত্যের জনক জাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন ২৯ এপ্রিল। তার প্রতি সম্মান জানাতে ও নৃত্যকলাকে উৎসাহিত করতেই দিনটি  আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়। সেই সুবাদে ‘মুক্তি সুরের ছন্দ’ প্রতিপাদ্যে মঙ্গল ও বুধবার দুই দিনব্যাপী বর্ণিল আয়োজনে নৃত্যদিবস উদ্যাপন করবে শিল্পকলা একাডেমি।

দিবসটি উদ্যাপনে আজ সন্ধ্যায় মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে পরিবেশনাসহ তিন পর্বে সজ্জিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নৃত্যাঞ্চল। এতে নৃত্যাঞ্চলের প্রাণপুরুষ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর স্মরণে গুণী ধামাইল শিল্পী শ্রীমতি কুমকুম নৃত্যাঞ্চল পদক প্রদান করা হবে। এছাড়াও থাকবে দিবসনির্ভর নানা আয়োজন।

×