
মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ পোহালে শর্বরী নাটকের দৃশ্য
পাল্টেছে সময়। কিন্তু বদলায়নি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের চরিত্র। সেই সুবাদে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত নারীকে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে নিগৃহের শিকার হতে হয়েছে নারীকে। মানুষের পরিবর্তে পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে নারী। যুগের পর যুগ অথবা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হতে হয়েছে অপদস্ত আর অপমানিত।
নারী বঞ্চনার আখ্যান মেলে ধরা তেমনই এক নাটক পোহালে শর্বরী। যে নাটকের গল্পে রাজ পরিবারের উত্তরাধিকার রক্ষার স্বার্থে নারী হয়েছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ধর্মের অনুশাসন ও রাজনীতির কূটচালে উপ-পতœীকে বেঁছে নিতে হয় শীলাবতী নামের রাজবধূকে। অন্যদিকে অমাত্য পরিষদের বেঁধে দেওয়া ধর্মের বেড়াজালে মল্ল রাজ্যের রাজা ওক্কাককে মেনে নিতে হয় সেই বিধান। নাট্যদল থিয়েটারের ৪৭তম প্রযোজনাটির একুশতম প্রদর্শনী হয় শনিবার।
বৈশাখী সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক সুরেন্দ্র বর্মার রচনা থেকে নাটকটি অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। নির্দেশনা দিয়েছেন রামেন্দু মজুমদার। সংযুক্ত নির্দেশনায় রয়েছেন ত্রপা মজুমদার। পোশাক পরিকল্পনা করছেন প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার।
প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার বলেন, বিষয়বস্তুর জন্যই আমরা এই নাটকটি মঞ্চে আনতে উৎসাহিত হয়েছি। কারণ নারীর অবস্থান আমরা আমাদের একাধিক নাটকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মহাভারতের ‘মাধবী’ থেকে আমাদের কালের ‘কোকিলারা’ কেবল পুরুষের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি দেড়-দু’হাজার বছরের আশপাশে এক কালখ-ে রাজবংশের উত্তরাধিকারের সংকটে নারীকে তার কামনা-বাসনার কোনো মূল্য না দিয়ে নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার এক কাহিনী বিধৃত হয়েছে এ নাটকে।
তার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মের অনুশাসন ও রাজনীতির কূট কৌশল-যার শিকার হয়েছে একইভাবে পুরুষও। নাটকটির প্রতিটি চরিত্রের জন্য দু’জন করে অভিনেতা অভিনয় করেছে। ফলে একদিকে যেমন দলের বেশি কর্মী কাজের সুযোগ পেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি কারও সমস্যার কারণে যেন প্রদর্শনী আটকে না যায়, সেটিও বিবেচনায় আনা হয়েছে।
তিন অঙ্কে বিধৃত হয়েছে নাটকের কাহিনী। রাজবংশের উত্তরাধিকারের সংকটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে কাহিনী। সেই উত্তরাধিকার পেতে চাপিয়ে দেয়া হয় ধর্মের নামে নানা অযৌক্তিক বিধি-বিধান। নিজের স্বামীকে ছেড়ে নারীকে খুঁজে নিতে হয় উপ-পতœী।
রাজ্য ছেড়ে রাজবধূকে চলে যেতে অন্য এক পুরুষের গৃহে। গল্পের সমান্তরালে অভিনয়শিল্পীদের কৌশলী অভিনয়ের গুণে ঝরেছে দর্শকের করতালি।
নাটকটির অভিনয়শিল্পীরা হলেন মাহমুদা আক্তার লিটা, নাজমুন নাহার নাজু, সামিয়া মহসীন, নূরে খোদা মাশুক সিদ্দীকি, মুশফিকুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম সজীব, তানজুম আরা পল্লী, রাশেদুর রহমান ও ত্রপা মজুমদার। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন পলাশ হেন্ড্রি সেন। আবহ সংগীত পরিকল্পনা করেছেন তানভীর আলম সজীব। ¯œাতা শাহরিনের কোরিওগ্রাফিতে রূপসজ্জা করেছেন শুভাশীষ দত্ত তন্ময়।
ঠাকুরগাঁওয়ে ‘বৈশাখী লোকনাট্য ধামের গানের উৎসব’ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপন উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্যের সমন্বয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে তিন দিনব্যাপী ‘বৈশাখী লোকনাট্য ধামের গানের উৎসব’ শেষ হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে আয়োজিত বৈশাখী লোকনাট্য উৎসব মঞ্চে স্থানীয় জ্যোতিরাজ লোকনাট্য দল ‘ওয়ার্ড মেম্বারনি ও মূর্খ স্বামী’ হাস্য রসাত্মক নাটক মঞ্চায়নের পর জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আলমগীর শুক্রবার মধ্যরাতে উৎসবের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এর আগে বুধবার রাত ৯টায় জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার হরসুয়া-নোয়ালি লোকনাট্য দল ‘মিঠা সাধু ও ক্রিমিনাল শিষ্য’ এবং পরের দিন একই উপজেলার গজেন বাবু লোক নাট্যদল ‘বিশ^ ঘটক ঘেচকেটা বর’ নামে পৃথক দুটি নাটক মঞ্চায়ন করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্য ও চলচ্চিত্র বিভাগের আয়োজনে ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
লোকসংস্কৃতিতে ‘ধামের গান’ টিকে আছে সগৌরবে ॥ আকাশ সংস্কৃতির দাপটে গ্রামবাংলার জনপদ মাতানো সব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। লোকসংস্কৃতির অন্যসব শাখা যেখানে বিলুপ্তির পথে সেখানে ‘ধামের গান’ আজও সগৌরবে টিকে আছে। বিশেষ করে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সাধারণ ঘটনা রঙ্গরসের মাধ্যমে পরিবেশনার কারণে ‘ধামের গান’ উত্তরাঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
এর ঐতিহ্য শহরবাসীর কাছে তুলে ধরতে এবার ঠাকুরগাঁও জেলা শিল্পকলা একাডেমি খোদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী লোকনাট্য ধামের গানের উৎসব। এতে জেলা শহরের সর্বস্তরের মানুষ ব্যাপক উদ্দীপনায় আনন্দ উপভোগ করেন।
জানা যায়, ‘ধাম’ শব্দের অর্থ নিবাস বা আশ্রয়স্থল। এ আশ্রয়স্থল দেব দেবীর। অর্থাৎ ধাম বলতে ধর্মীয় স্থানকে বোঝায়। আরাধ্য দেবতাকে তুষ্ট করতে ধামের গানের উৎপত্তি। এখনো প্রতিবছর লক্ষ্মী ও কালী পূজায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসানো হয় ধামের গানের আসর।
ধামের গানের আয়োজক ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গান পরিবেশনার একটি ব্যতিক্রমী দিক হলোÑ ধামের গানের নির্দিষ্ট কোনো রচয়িতা নেই। পালা মৌখিক ও তাৎক্ষণিকভাবে রচিত। এখানে পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। তারা পেশাদার শিল্পী নন। কেউ বর্গাচাষি, কেউ ভ্যানচালক আবার কেউ খেতমজুর। সমাজ জীবনের ঘটনা সাধারণত স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় পরিবেশন করা হয়। ব্যবহার করা হয় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
ধামের গান উঁচু চারকোনা মাটির তৈরি মঞ্চ বা আসরে পরিবেশন করা হয়। মঞ্চের চার কোনায় থাকে কলাগাছ বা জিকাগাছ দিয়ে তৈরি করা খুঁটি। আসরের মধ্যবর্তী জায়গায় শিল্পী ও কলাকুশলীরা বৃত্তাকারে বসেন। সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বৃত্তাকার অংশের চারদিকে ফাঁকা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অভিনয় ও গীত পরিবেশন করেন।
সড়কের পাশে বটগাছের তলায় চলে ধামের গানের আসর। সেখানে দুই ফুট উঁচু করে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় চারকোনা মঞ্চ। মঞ্চ আলোকিত করতে ব্যবহার করা হয় নানা রঙের লাইট। সেখানে পরিবেশিত হয় ‘বাবার চোখের জল’সহ বিভিন্ন নামের পালা।
কাশিডাঙ্গী ধামের সভাপতি লক্ষ্মী ম-ল জানান, ৫০ বছর ধরে তারা প্রতিবছর ধামের গানের আয়োজন করে আসছেন। এখনকার মানুষ মুঠোফোন ও টেলিভিশনে মেতে থাকলেও ধামের গান আয়োজন করে আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
ধামের গানের শিল্পী-কুশলীরা জানান, ধামের গানের ঐতিহ্যের মধ্যে এখনো যা রয়েছে তার মধ্যে পুরুষরা নারী সাজেন এবং নারীর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। তারা মুখে মেকআপ, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখার পর পরচুলার সঙ্গে পোশাক পরেন। দর্শকরা তাদের অভিনয় আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যশিল্পী অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে জানান, উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চিত্র গ্রামীণ নাট্যধারা ধামের গানের মাধ্যমে পরিবেশন করে থাকে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের যে জীবন, জীবনের নানা দিক, তা হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন শিল্পীরা। অন্য যেসব বিনোদন মাধ্যম রয়েছে সেগুলোকে ছেড়ে সাধারণ মানুষ ধামের গান উপভোগ করেন। গ্রামের মানুষ তাদের নিজের কথা এখানে দেখতে পান বলেই ধামের গান তাদের কাছে এখনো আবেদন সৃষ্টি করে।